আল মাহফুজ
‘আবার দেখা হবে, এখনই শেষ দেখা নয়
আবার কথা হবে, এখনই শেষ কথা নয়..’
প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে এই গান গেয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী খালিদ। আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক। ভেবেছিলাম, বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা খালিদের কণ্ঠ থেকে বাংলাদেশের কোনো এক কনসার্টে আবার গানটি শোনা হবে। হয়তো খালিদ স্টেজ মাতাবে ‘দূর পরবাসে’ থাকা আশিকুজ্জামান টুলুকে সঙ্গে করে। হয়তো আবার ‘চাইম’ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে টিএসসি কিংবা হাতিরঝিল এম্পফিথিয়েটারে। কিন্তু নাহ্, আমরা যা আশা করি, তা পূরণ হয় না। লাখো লাখো সংগীতপ্রেমিকে কাঁদিয়ে খালিদ উড়াল দিলেন অন্য কোনো জগতে। তবে খালিদ, আপনার সাথে আমাদের আবার দেখা হবে। দেখা যে হতেই হবে।
যতোটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে, ততোটা মেঘ বুকে রেখেছি পুষে, কীভাবে আমায় তুমি কাঁদাবে বলো?
খালিদ কি অভিমান বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন? পুষেছিলেন গোপন কোনো ব্যথা? এক আঁজলা যন্ত্রণায় কি বিদীর্ণ হচ্ছিল শিল্পী সত্তা? তা না হলে তিনি গাইবেন কেন– ‘একটা মানুষ কত সয়ে বাঁচতে পারে, একটা হৃদয় কত পুড়ে জ্বলতে পারে?’ প্রিন্স মাহমুদের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু যারা গানটি শুনেছেন, তারা বলতে বাধ্য হবেন– বুকের ভেতরে ভিসুভিয়াসের দহন না থাকলে এমন দরদ দিয়ে গানটি কণ্ঠে তোলা সম্ভব নয়। এই জনপ্রিয় গায়কের বুকে কি হিমালয়সম দুঃখ ছিল? জানা হবে না হয়তো আর।
খালিদের গান আশি-নব্বইয়ের দশকে পাড়া-মহল্লায় বাজতো। বাজতো বিপণিবিতানসহ ক্যাসেটের নানা দোকানে। শ্রোতাদের মুখে মুখে থাকতো ‘নাতি খাতি বেলা গেল’, ‘আকাশনীলা’ অথবা নব্বইয়ের শেষের দিকে ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’। তারা গানটি শুনে নিজেদের জীবন থেকে বিদায় নেয়া প্রেমিকার কথা ভাবতো। খালিদ বাজতো ক্যাসেটে আর শ্রোতার হৃদয় স্মৃতির জাবরে মথিত হতো। কোনো বাঁধনেই কেন প্রিয়তমাকে ফেরানো যায়নি, এই অবিশ্বাস্য অনুতাপের আগুন জল হতো খালিদের গানে। সেই খালিদকে কোনো কারণেই কেন ফেরানো গেল না? আমরা নিরুত্তর। তবে বিদায়ের দিনে একটা কথা মনে বাজছে– শিল্পীর মৃত্যু নেই, দেহাবসান হয় মাত্র।
১৯৮৩ সাল থেকে ‘চাইম’ ব্যান্ডে যোগ দেন খালিদ। তখন গানের জগতে তার প্রবেশের বছর দুয়েক হয়েছে। চাইমের হয়ে একের পর এক মন মাতানো গান উপহার দিয়ে অল্প সময়েই খ্যাতি পান এই কণ্ঠশিল্পী। গত শতাব্দির মানুষেরা খালিদকে চিনতো ‘চাইম’ ব্যান্ডের খালিদ নামেই। ‘কীত্তনখোলা’, ‘আজকে রাতে যে গান তুমি মোরে শোনালে’, ‘সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ‘, ‘মরে মরে বেঁচে আছে’, ‘পড়ালেখা শেষ করে’র মতো অসংখ্য গান অনবদ্য এই গায়কের কণ্ঠে পেয়েছে প্রাণ। এক নতুন ‘টেস্ট অব মিউজিক’-এ মশগুল হয়ে পড়ে ব্যান্ডের শ্রোতারা।
হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সব কিছু, শেষ করে কেন চলে গেছো?
চাইমের ভোকাল হলেও খালিদের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিলো একক গানেও। নব্বই বা শুন্য দশকে প্রিন্স মাহমুদের মিক্সড অ্যালবামে প্রায়ই পাওয়া যেতো খালিদকে। শ্রোতারা জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর পাশাপাশি উৎকীর্ণ হয়ে শুনত খালিদের গাওয়া গান। ‘কোনো কারণেই’, ‘যদি হিমালয় হয়ে’, ‘নীরা ক্ষমা করো’, ‘ঘৃণা’, ‘আমায় যদি পড়ে মনে’, ‘ঘুমাও’, ‘এক মহাকাল ব্যথা’ ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা প্রিন্স মাহমুদ। তার (তরুণ মুন্সীর লেখা) ‘সরলতার প্রতিমা‘ গানটা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
খালিদের গান একবার শুনেই কানে লেগে থাকতো। চোখ বুজে আসতো সুরের সম্মোহনে। মনে দোলা দিতো বারবার। যতবারই শোনা হোক না কেন, প্রত্যেকবার নতুন করে শোনার অভিজ্ঞতা হতো। ‘হয়নি যাবার বেলা’ গানে খালিদ গেয়েছিলেন– ‘হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সব কিছু শেষ করে কেন চলে গেছ?’ বিদায়ের মর্মর পাথরে আজ লেখা হোক এপিটাফ– ‘আমাদেরও তোমাকে কিছু বলার ছিল। বলা হলো না, প্রিয় শিল্পী। ভালোবাসার আখর অবজ্ঞা করে কি যাতনাকে সখ্য করা যায়?
যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে এ হৃদয়ে, সে কিছু নয়?
নব্বই দশক শেষ। বাংলাদেশের মিউজিকের প্রায় সবখানেই ভাঙনের সুর। কেউ কেউ ভিন্ন পথে হাঁটলেও যেন ডুবে যান অল্প কদিনেই। কিছুতেই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না সোনালি সময়। খালিদও হারিয়ে গেলেন। অতল গহ্বরে। কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। একদিন হঠাৎ ফিরে এলেন। তাকে নতুন গানে ফিরিয়ে আনলেন প্রিন্স মাহমুদ। প্রিন্স মাহমুদ খালিদকে দিয়ে গাওয়ালেন নতুন শতাব্দীর বিস্ময়কর এক গান। ততোদিনে ক্যাসেট-সিডির যুগের অবসান। এফএম রেডিওর দখলে বাংলা গান। সবগুলো রেডিও স্টেশনের শীর্ষে জায়গা করে নেয় প্রিন্স মাহমুদের গান– ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’। খালিদ ফিরলেন স্বমহিমায়। খালিদ হয়ে গেলেন নতুন প্রজন্মের প্রিয় এক নাম।
এমন অনেক গানে কণ্ঠের মুন্সিয়ানায় খালিদ ছড়ালেন মহুয়ার সৌরভ। এ দেশের মানুষের অগুনতি মন খারাপের রাতের সঙ্গী ছিলেন এই গায়ক। এখনও মন খারাপ হলে শ্রোতারা হয়তো দরদিয়া শিল্পীর কণ্ঠেই আশ্রয় খোঁজে। এখন রাতের জানলা খুললে আকাশ দেখা যাবে, বুকটা ভরে শ্বাসও নেয়া যাবে। কিন্তু ব্যথার দল কি নির্বাসনে যাবে? আহ, খালিদ! আপনি এভাবে চলে গেলেন!
“আমায় যদি পড়ে মনে
কবিতায় কবিতায়
মগ্ন থেকো
আসে না যেনো জল
চোখেরই কোণে..”
Leave a reply