মুরশিদুজ্জামান হিমু⚫
১৯৯৫-৯৬ সালের কথা। সে সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে বাচ্চু, জেমস, হাসানরা। অ্যালবাম বের হলেই হিট। এরইমাঝে হঠাৎ কানে বেজে উঠলো এমন কিছু তান, যেটি শুনতে একটু আলাদা। মেলোডির সঙ্গে রকের মিশ্রণ। একটি অ্যালবাম বের হলো, নাম ‘পেপার রাইম’। নিজেদের ব্যান্ডের নামেই অ্যালবামটির নামকরণ। যেখানে ছিল জনপ্রিয় কিছু গান– ‘অন্ধকার ঘরে’, ‘এলোমেলো’, ‘আকাশের কী রং’ প্রভৃতি। গানগুলো ঠিক রাইম বা কবিতার মতোই। অ্যালবাম ঘেঁটে বের করা হলো, ভোকালের নাম আহমেদ সাদ।
তাদের একটা গান তো রীতিমত হৃদয় ছুঁয়ে গেলো সবার। সময়ের সঙ্গে সেটি রচনা করলো ইতিহাসও। সে সময় তরুণদের মুখে মুখে ফিরতো ‘অন্ধকার ঘরে’ গানটি। গুন গুন করে তারা গাইতো–
‘নিকষ কালো এই আঁধারে
স্মৃতিরা সব খেলা করে
রয় শুধু নির্জনতা
নির্জনতায় আমি একা,
একবার শুধু চোখ মেলো
দেখো আজও পথে জ্বালি আলো
তুমি আবার আসবে ফিরে
বিশ্বাসটুকু দু’হাতে আকড়ে ধরে।’
‘ভিনি ভিডি ভিসি’র সার্থক রূপায়ণ
তখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ ছিল না। হুটহাট এই গানের ব্যান্ড, গায়ক, সুরকার-গীতিকারের আদ্যোপান্ত বের করাও কঠিন ছিল। কিন্তু যে গান শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেছে, তারাও তো থামবার নয়। অ্যালবামের ফ্ল্যাপে কিছু তথ্য হয়তো পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে শ্রোতাদের ক্ষুধা যেন মিটছে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারা বের করে ফেললেন, ‘পেপার রাইম’র সবকিছু। বের করে ফেললেন সাদ, নাসের, সুমন জামান, রাশেদ, অভিকের বন্ধুত্বের রসায়ন। অনেকেরই সে সময় মুখে মুখে ছিল, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র হুট করেই একটি ব্যান্ড ফর্ম করে ফেললেন এবং এক অ্যালবামেই জয় করলেন অনেক কিছু। যেন এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন, এমনই ছিল ‘পেপার রাইম’র পথচলার আখ্যান।
‘নিকষ কালো’ প্রদীপের আড়াল
প্রথম অ্যালবাম দারুণ সাড়া ফেললো। কিন্তু এরপরই হঠাৎ উধাও কেন তারা? অনেকে খোঁজাখুজি করেছেন। কিন্তু কুলকিনারা হয়নি। মিডিয়ার আলোও পড়েনি সাদ-রাশেদ-অভিকদের দিকে। তাই ধীরে ধীরে অনেকের স্মৃতি থেকে হারিয়েও যায় ‘পেপার রাইম’ নামটি। কিন্তু ‘নিকষ কালো’ গানটি ভোলেননি শ্রোতারা। এ প্রজন্মেরও যারা পেপার রাইমকে সেভাবে জানেননি-শোনেননি, সে তালিকার অনেকেও ব্যান্ডটির অসামান্য লিরিক আর টিউনের ফ্যান। এখনও রাত জেগে গানটি শোনেন আর ভাবেন, কম্পোজিশন এমনও হয়!
মাঝে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ব্যান্ডটি আবারও জোড়া লাগার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। যারা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির খোঁজ রাখেন, তারা বিষয়টি হয়তো জেনে থাকবেন। ২০০৯ সালের দিকে আবারও ‘পেপার রাইম’ টিম হিসেবে শুরু করতে চাইছে। ব্যান্ডের ড্রামার অভিক দেশে ফিরে সবাইকে এক করছেন।
সবকিছু যখন অনেক দূর এগিয়েছিল, তখনই বাধা হয়ে দাঁড়ালো ভোকাল সাদের অসুস্থতা। ক্যানসার ধরা পড়ে তার। পরে চিকিৎসার জন্য সাদ দেশের বাইরে যান। একসময় জানা গিয়েছিল, সাদ অনেকটাই সুস্থ। কেটে গেছে সব অনিশ্চয়তা। আবারও মঞ্চে দেখা যেতে পারে পেপার রাইমকে।
কিন্তু দুর্যোগের ঘনঘটা যে ফিরে আসতে পারে, সেই শঙ্কা সত্যি হয় সাদের বেলায়। আবারও ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। হয় হার্ট অ্যাটাকও। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) মৃত্যুর কাছে হার মানলেন সুরেলা সরল এই মানুষটি।
সঙ্গীতাঙ্গনে অনেক অবদান হয়ত রাখতে পারেননি সাদ ও তার ব্যান্ড ‘পেপার রাইম’। কিন্তু মাত্র একটি অ্যালবাম করে ‘নিকষ কালো এই আধারে’র মতো গানই বা রেখে যেতে পেরেছেন কজন? সাদ সশরীরে হয়ত নেই, কিন্তু তার সেই গান যে আরও বহু বছর থাকবে মানুষের হৃদয়ে, একথা হলফ করেই বলা যায়। হলফ করে বলা যায়, সাদের গাওয়া এই গান স্বর্ণালি চাদর হয়ে ওম ছড়াবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
/এমএমএইচ
Leave a reply