নাম্বার নাইনহীনতায় ব্রাজিল, কে দেখাবে আলো?

|

ছবি: সংগৃহীত

রাকিবুল ইসলাম মিতুল:

ব্রাজিলিয়ানরা খেলা বলতে বোঝে ফুটবল। ফুটবল নিয়ে কথা বলবেন আর সেখানে ব্রাজিলের নাম উঠবে না সেটি বিরল। কারণ ফুটবলে ব্রাজিলের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস তার নজির গোটা পৃথিবীতে এখনও অনন্য। কিন্তু গেল কয়েকটা বছর বেশ বিষাদেই কেটেছে ব্রাজিলের। দারুণ একটা দল, দুর্দান্ত সব তারকা নিয়েও বড় আসরগুলোতে বারবার খেয়েছে হোঁচট। সেই সোনালি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সোনালি ট্রফির স্পর্শ নেয়া হয়নি নেইমারদের। কখনও নকআউটে, কখনও আরেকটু এগিয়ে ঠিকই বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাদের।

ফুটবলকে ব্রাজিলিয়ানরা কীভাবে দেখেন, সেটা দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিসের কাছ থেকেই শোনা যাক, ফুটবল এমন একটি খেলা, যার সৃষ্টি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা, বুদ্ধিবৃত্তি, বিলাসিতা, স্বাধীনতা এবং আমাদের সবচেয়ে আদি প্রবৃত্তিগুলোর অংশ, যেমন নাচ থেকে।

ব্রাজিলের স্পর্শে ফুটবল নামের সেই খেলাটি মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায় শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরে। যে কারণে ১৯৫০ বিশ্বকাপে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে গোল বাঁচাতে না পারা ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক মোয়াকির বারবোসাকে ‘অভিশপ্ত’ হয়ে কাটাতে হয় গোটা জীবন। আবার তিনটি বিশ্বকাপ জেতানো পেলেকে অমরত্বের মর্যাদা দেয়া হয়।

এতক্ষণ যা বলা হলো, সেসব শুধুই অতীতের চাদরে মোড়া জং ধরা এক গল্প। যে গল্পে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে ধুলা জমতে শুরু করেছে। যেন মেঘের জাল গুটিয়ে আকাশে ফিরে গেছেন অভিজ্ঞ মল্লার। ব্রাজিলের ফুটবল এখন যেন হারানো সেই ঐতিহ্য ফিরে পেতে গুমরে কাঁদছে। তার সিংহভাগের কারণ দলটির পারফেক্ট নাম্বার নাইনহীনতা।

তবে নামটা যখন ব্রাজিল তখন তো স্বপ্ন দেখাই যায়। শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই নয়, বিশ্বের নামিদামি ক্লাবে খেলেন ব্রাজিলের ফুটবলাররা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে রোনালদো দ্য লিমা অবসরে যাওয়ার পর সেরকমভাবে কেউ নাম্বার নাইন পজিশনে মানিয়ে নিতে পারেননি।

১৮ বছর ধরে ব্রাজিলের ফুটবলে নাম্বার নাইন পজিশনের যে দুঃসময় পার করছে, তা সম্ভবত নজিরবিহীন। এতটা হতশ্রী ও দিশাহীন সময় বোধ হয় ব্রাজিলের ফুটবল কখনো পার করেনি। রোনালদো অবসরের পর অনেককেই তার উত্তরসূরি ভাবা হতো কিন্তু মাঠের ফুটবলে তার ছিতেফোটাও দেখা মেলেনি।

রোনালদো বিদায়ের পর ব্রাজিলে খেলা নাম্বার নাইনের তালিকা ও পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো:

রবিনহো: ব্রাজিলের ফুটবলে অনন্ত আক্ষেপ হয়ে ওঠা এক নাম রবিনহো।  শুরুর দিকে যাঁকে ‘নতুন পেলে’ও বলা হতো। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার সিটি ও এসি মিলানে খেলা এই ফরোয়ার্ড পরে নিজের সম্ভাবনার অল্পই মাঠে অনূদিত করতে পেরেছেন। রোনালদো অবসরের পর তিনিই ব্রাজিলের নাম্বার নাইন পজিশনে খেলেছিলেন। কিন্তু থিতু হতে পারেননি। ফুটবল-আঙ্গিনার আলোচনা থেকে হারিয়ে গেছেন এক সময়ের এই স্টারবয়।

আদ্রিয়ানো: ব্রাজিলের হয়ে ৪৮ ম্যাচে ২৭ গোল করে রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিলেন আদ্রিয়ানো। তার অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে ফ্লামিঙ্গো থেকে নিজেদের ডেরায় ভেড়ায় ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান। তার পারফরম্যান্সে সেবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করে ইন্টার মিলান। তারপর তাকে ‘এম্পেরর অব মিলান’ নামে আখ্যা দেয়া হয়।

কিন্তু অমিত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মালেও নামের পাশে আক্ষেপ ছাড়া শেষ পর্যন্ত কিছুই রাখতে পারেনি। গোল্ডেন বুট জয়ী এই ব্রাজিলিয়ান হতে পারতেন ফুটবল সম্রাট। অসামান্য প্রতিভা থাকলেও বাবার মৃত্যুতে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেন নিজের জীবন। মদের নেশায় ডুবে থাকতে থাকতে ডুবিয়ে দেন নিজের ক্যারিয়ারও। বিলাসী জীবন যাপন করা এই ব্রাজিলিয়ান তারকা নিজের কর্মদোষে বস্তিবাসীও হয়েছিলেন।

লুইস ফ্যাবিয়ানো: ২০১০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন লুইস ফ্যাবিয়ানো। হলুদ জার্সিতে ৪৭ ম্যাচে করেছিলেন ২৮ গোল। ২০০৯ সালে কনফেডারেশন্স কাপে ৫ গোল দিয়ে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ৯টি গোল এবং মূল বিশ্বকাপেও ৩টি গোলের দেখা পেয়ছিলেন ফ্যাবিয়ানো। সেভিলা, সাও পাওলোর মতো ক্লাবের হয়েও মাঠ মাতিয়ে ছিলেন। তবে তৎকালীন ব্রাজিলের কোচ দুঙ্গার বিদায়ের পর সেলেসাওদের হয়ে আর মাঠে দেখা যায়নি ফ্যাবিয়ানোকে।

অ্যালেক্সান্ডার পাতো: এক সময় পাতোকে মনে করা হচ্ছিল রোমারিও, বেবেতো, রোনালদোদের যোগ্য উত্তরসূরি। ব্রাজিলের জার্সিতে ২৭ ম্যাচে করেছিলেন ১০ গোল। তারকা খ্যাতি পেয়ে এসেছিলেন ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানে। ইতালিতে এসে সাত বছর পর মিলানকে জেতান লিগ শিরোপা। তবে ইনজুরি তার ক্যারিয়ারকে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ করছিলো। আর ঠিক সেই কারণেই নিজের লক্ষ্য থেকে কিছুটা হলেও নড়ে গিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রো পাতো।

কিন্তু বিভিন্ন কারণে টিকতে পারেননি সেখানে। পরবর্তীতে পাড়ি জমান অর্থের ঝনঝানিতে পরিপূর্ণ লিগ চাইনিজ সুপার লিগে। কিন্তু সেখানেও টিকে থাকতে পারেননি পাতো। ইনজুরি এবং মাঠের বাইরের কারণে অকালেই হারিয়ে গেছেন। মাঠের বাইরের উচ্ছৃঙ্খল জীবন এবং পার্টি তাঁকে ইনজুরিতে পড়তে সাহায্য করেছিলো। এরপর হয়ে রইলেন মহাকাশের উল্কার মতো।

ফ্রেড: মনে পড়ে, ব্রাজিলের ২০১৩ সালের ফিফা কনফেডারেশন কাপ জয়ের কথা? নাম্বার নাইন ফ্রেড যেন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন রোনালদো আর নাম্বার ৯ এর যোগ্য উত্তরসূরি। দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে ব্রাজিল দলে এসেছিলেন ফ্রেড। তরুণ ফ্রেডকে নিয়ে রীতিমত ট্রান্সফার মার্কেটে কাড়াকাড়ি লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল। তার মধ্যে হয়ত প্রতিভার ছিটেফোঁটা লক্ষ্য করেছিল ইউরোপের বেশকিছু ক্লাব। সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ক্রুজেইরোর হয়ে ৪৩ ম্যাচে ৪১ গোল করে নজরে আসেন ফ্রেড। এই স্ট্রাইকার ব্রাজিলের হয়ে ৩৯টি ম্যাচ খেলে ১৮ গোল করেন।

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের আক্রমণভাগটা সবসময় দখলে ছিল তারকার ফুটবলারদের। সেখানটায় পেলে, সক্রেটিস, রোনালদিনহো, রোনালদো, রোমারিও থেকে শুরু করে নেইমারদের মতো তারকারা সামলেছেন আক্রমণের দায়িত্ব। এই তালিকায় ফ্রেড যেন বড্ড বেমানাম। তিনি যেন ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শিশু। তাইতো বেশ প্রশ্ন জাগে, কি করে তিনি ব্রাজিলের মতো একটি দলের বিশ্বকাপের মঞ্চের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন? জাতীয় দলে তার পারফরমেন্সকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যেন যায়না। রহস্যে ঘেরা থাক ফ্রেডের ক্যারিয়ার।

গ্যাব্রিয়েল জেসুস: গ্যাব্রিয়েল জিসুস ব্রাজিল দলে সুযোগ পেয়েই নিজের জাত চেনান। বাছাই পর্ব কিংবা প্রীতি ম্যাচ, গোল যেন তার কাছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলশ্রুতি হিসেবে দ্রুতই খেতাব পেয়ে গেলেন রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি। ২০১৫ সালে অনুর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে নেন। একই বছর পালমেইরাস মুল দলে জায়গা করে নিয়েই জিতে নেন বেস্ট নিউকামার এওয়ার্ড। ২০১৬ সালে ব্রাজিলকে এনে দেন অধরা অলিম্পিক স্বর্ণপদক। একই বছর ব্রাজিলের নতুন কোচ তিতের অধীনে ব্রাজিল দলের ঐতিহাসিক ৯ নাম্বার জার্সি গায়ে চড়ান। ২০১৭ সালের জানুয়ারি তে পাড়ি জমান ইংল্যান্ড এ, ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নাম লেখান জেসুস।

কিন্তু বিধি বাম! বিশ্ব মঞ্চে এসেই যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। তার প্রতিভা কিংবা দক্ষতা কোনোটা নিয়েই কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। কিন্তু ইনজুরি তাকে বারংবার দূরে ঠেলে দেয়। আর্সেনালের হয়ে ক্লাব ফুটবলে মাঠ মাতালেও বর্তমানে ব্রাজিল দলে বেঞ্চ গরম করতে দেখা যায় জেসুসকে।

রিচার্লিসন: রোনালদো দি লিমার পরে ব্রাজিল দলে আরো বেশ ক’জন নাম্বার নাইন এসেছেন। কিন্তু ব্রাজিলের হেক্সা জয়ের পথে কেউই সেই দৌড়টা শেষ করতে পারেননি। কাতার বিশ্বকাপে এসে সেই দৌড়ের পথে দুর্দান্ত গতিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রিচার্লিসন। ওই আসরের চোখ ধাঁধানো ‘বাইসাইকেল কিক’ করে মুগ্ধ করেন বিশ্ববাসীকে। টুর্নামেন্টে ৩ গোল করে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারও তিনিই ছিলেন।

এরপরেই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন ‘রিচি’। ক্লাব ফুটবলে টটেনহ্যামের হয়ে গোলের নিশানা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন ২৬ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ড। মৌসুমের পুরো সময় কাটিয়ে ফেললেও গোলের দেখা পান কালে ভদ্রে। বাজে ফর্মের কারণে তার ওপর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ক্লাব ও জাতীয় দলের কোচরা। চলতি কোপা আমেরিকা ব্রাজিল দল থেকেও বাদ পড়েছেন তিনি।

নিভে যাওয়া তারাদের ভীড়ে এবার আশার প্রদীপ জ্বলানে এক তরুণ তুর্কির কথা বলবো। তার নাম এন্ড্রিক ফেলিপে। এন্ড্রিকের বয়স এখন ১৮ ছুঁইছুঁই। অমিত প্রতিভা দেখে ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর এন্ড্রিককে নিজেদের ডেরায় ভেড়ায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ।

মূলত নেইমারের চোটের কারণে তাকে দলে ভিড়িয়েছিলেন ব্রাজিলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কোচ ফার্নান্দো দিনিজ। আর এতেই রোনালদো নাজারিওর পাশে নাম লেখান এন্ড্রিক। কারণ পেলে, রোনালদোর পর তিনিই যে এখন জাতীয় দলে ডাক পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ ব্রাজিলিয়ান। হলুদ জার্সিতে অভিষেকের পর থেকেই দ্যুতি ছড়ান এই টিনেজ।

পালমেইরার্সের টিনএজ স্ট্রাইকার এন্ড্রিক অবশ্য এরই মধ্যে আগামীর তারকা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। তাই ব্রাজিল ফুটবলের নতুন রোনালদো হয়ে হারানো গৌরব ফিরিয়েও আনতে পারেন তিনি। তাতে করে ব্রাজিলের দীর্ঘদিনের নাম্বার নাইনহীনতার অভাব পূরণ হবে সেলেসাওদের।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply