মেহেদি হাসান রোমান⚫
২০০২ সালের ৩০ জুন। জাপানের ইয়াকোহামায় শেষবার ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিল সেলেসাওরা। ফাইনালে সেবার জার্মানিকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ায় আয়োজিত বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের জার্সিতে পাঁচটি তারকা বসাতে সক্ষম হয় লাতিন আমেরিকার ফুটবল পরাশক্তির এ দেশটি। কিন্তু এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ দুই দশক। আর ফাইনালের দেখা পায়নি কাফু-রোনালদিনহোদের উত্তরসূরিরা। শুধু কি তাই, ব্রাজিলের সামনে নতুন এক অদৃশ্য বাধা এসে হাজির হয়েছে, যার নাম ‘কোয়ার্টার ফাইনাল’। বেশিরভাগ বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের শেষ আটে নিয়মিত স্বপ্নভঙ্গ হতে দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলের।
‘জুজু’ শব্দের একটি মিথগত অর্থ রয়েছে। সাধারণত ভয় অর্থে এটিকে ব্যবহার করা হয়। তবে গত দেড় দশকে ব্রাজিল যেন সেই ‘জুজু’র একটি সমার্থক শব্দের জন্ম দিয়েছে। জুজু মানে ব্রাজিলের কাছে ভয় নয়, জুজু মানে কোয়ার্টার ফাইনাল।
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। সেবার প্রথম রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও জাপানের বিপক্ষে টানা তিন জয়ে রাউন্ড অব সিক্সটিনে ওঠে সেলেসাওরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে ঘানাকে সহজেই হারিয়ে শেষ আটের টিকিট পায় রোনালদিনহোরা। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে চার ম্যাচে এক গোল হজম করার বিপরীতে তারা প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠায় ৭ বার। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ছন্দপতন। জিদানের অনবদ্য পারফরম্যান্সে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের পুনঃপ্রচার যেনো দেখতে পায় সেলেসাও শিবির। ম্যাচে অঁরির একমাত্র গোলে কোয়ার্টার ফাইনালেই শেষ হয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিশ্বকাপ যাত্রা।
২০১০ সালে আফ্রিকা মহাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও ফেবারিট ছিলো ব্রাজিল। দলের প্রাণভোমরা কাকা তখন নিজের প্রাইম টাইম পার করছেন। সেবারও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের সাথে ‘ড্র’ করলেও আইভোরি কোস্ট ও উত্তর কোরিয়াকে হারিয়ে গ্রুপ টেবিলের টপার হয়েই নকআউট পর্বে ওঠে তারা। রাউন্ড অব সিক্সটিনে চিলিকেও বড় ব্যবধানে হারিয়ে শেষ আটের টিকিট কাটে সাম্বা ফুটবলের দেশটি। চার ম্যাচে দুই গোল হজমের পাশাপাশি প্রতিপক্ষের জালে তারা বল জড়ায় ৮ বার। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস। রবিনহোর গোলে ম্যাচে লিড নিলেও দ্বিতীয়ার্ধে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল হজম করে ব্যাকফুটে চলে যায় কাকারা। ফলাফল আবারও কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায়।
২০১৮ বিশ্বকাপেও কোয়ার্টার ফাইনালের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি তারা। বরাবরের মতো একই গল্প। সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া ও কোস্টারিকার গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে মেক্সিকোর বিপক্ষে দারুন এক জয়। কিন্তু শেষ আটের সেই জুজুর ভয় আবারও। কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে বাড়ির পথ ধরতে হয় নেইমারদের।
২০২২ বিশ্বকাপ। গল্প পরিবর্তন হয়নি মোটেও। আগের বিশ্বকাপের মতো এবারও গ্রুপ পর্বে সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ডকে পায় তারা। তাদের বিপক্ষে জিতলেও হেরে যায় ক্যামেরুনের বিপক্ষে। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে শেষ আটে। কিন্তু এরপর? আবারও কোয়ার্টার ফাইনাল, আবারও হার। ২০০২ সালের পর থেকে দুই দশক ধরে ব্রাজিল ভক্তদের স্বপ্নের ‘হেক্সা মিশনে’ এবার পেরেক ঠুকে দেয় ক্রোয়েশিয়া।
বিশ্বকাপের বাইরেও নিজেদের মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কনমেবল কোপা আমেরিকায় একাধিকবার কোয়ার্টার ফাইনালে স্বপ্ন ভেঙেছে ব্রাজিলের। ২০১১ কোপা আমেরিকায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েও শেষ আটে প্যারাগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় তাদের। পরের আসর ২০১৫ তেও একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে থামে তাদের কোপা যাত্রা। দুইবারই টাইব্রেকারে হেরে যায় ব্রাজিল।
সবশেষ কোয়ার্টার জুজু ২০২৪ কোপা আমেরিকা। উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিতে হয় দানিলোর দলকে।
তবে গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশিবার শেষ আটে ব্রাজিলের শিরোপা দৌঁড় থামলেও অর্জনও কিন্তু কম নয়। ২০০৪, ২০০৭, ২০১৯ কোপা আমেরিকা অবশ্য তারা জিতেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ফিফা কনফেডারেশন কাপের হ্যাটট্রিক শিরোপাও তারা ঘরে তুলেছে।
তবে, ২০১৪ সালে কোয়ার্টার পেরিয়ে সেমিতে ওঠায় স্বরণকালের সবচেয়ে বড় ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। সেবার ঘরের মাঠে ফিফা বিশ্বকাপের সেমিতে জার্মানির বিপক্ষে ৭ গোল হজম করে বসে দলটি। এতোবার কোয়ার্টার ফাইনালে বাধা পাওয়া দলটি সেবারও শেষ আটে থেকে গেলেই হয়তো ভালো করতো। কারন সেই সেমিতে ওঠা তাদের জন্য ইতিহাসের সেরা বাজে অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল।
আজও যখন সেই ৭ গোল নিয়ে ব্রাজিল সমর্থকরা হাস্যরসের শিকার হন আর এতো এতো কোয়ার্টার ফাইনালে স্বপ্নের যাত্রা শেষ হবার গল্প পড়েন, তখন দীর্ঘশ্বাস হয়ত বেরিয়ে আসে। অজান্তেই কেউ কেউ বলে ওঠে, বেলো হরিজন্তেতে কেনো সেমিফাইনাল খেলতে গিয়েছিলাম? সেবারও কোয়ার্টারে যাত্রা শেষ হলে মন্দ হত না।
/এমএইচআর
Leave a reply