নিক্কেই এশিয়ার বিশ্লেষণ-শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশে প্রয়োজন নতুন পররাষ্ট্রনীতির

|


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের সাম্রাজ্যের ‘পতন’ হয়েছিলো বিদ্যুৎ গতিতে। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণভবন ঘেরাও এবং প্রধানমন্ত্রীর ভারতে পালিয়ে যাওয়া ছিলো আরও অপ্রত্যাশিত।

শেখ হাসিনার হঠাৎ করে এভাবে চলে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে যে শূন্যতা তৈরি করেছে, সেটির প্রভাব দৃশ্যমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।

সোমবার (১২ আগস্ট) জাপানি গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া ‘আফটার হাসিনা, বাংলাদেশ নিডস এ ফরেইন পলিসি রিসেট’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেখানে বলা হয়, দেশটির অর্থনীতিতে সীমাহীন দুর্নীতি জনগণকে বছরের পর বছর ধরে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। যদিও শেখ হাসিনা সরকার আসার পর আগের তুলনায় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন হয়, তবে তার দলীয় লোকজনের দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারে দেশটির অর্থনীতি দারুণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে এক দশকের মধ্যে।

এছাড়া তার শাসনকালে, প্রতিটি নির্বাচন নিয়ে কারচুপির অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত। ভিন্ন মত দমনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এতটাই কঠোর ছিলেন যে, তার শাসনামলে কেউ কথা বলার সাহস করত না। কেননা, তার বিরুদ্ধে অনেক গুম, খুনের সুষ্ঠু তদন্ত না করার অভিযোগ রয়েছে।


বাংলাদেশের পটভূমিতে, ‘রাজনীতি ও অর্থনীতি’ অভেদ্য অংশ। অব্যস্থাপনা ও দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করায় বাংলার রাজনীতিতে এর অস্বীকারসূচক প্রভাব পরিষ্কার হয়ে ওঠে জনগণের সামনে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের বিশ্বাস, আস্থা ও শ্রদ্ধা; সবই হারিয়েছেন শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের সবশেষ নির্বাচন বিএনপি এবং অন্যান্য দলগুলো বর্জনের পর হাসিনা বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতা শুরু করেছিলেন। তবে মাত্র ৭ মাসের মাথায় তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। বলা যায়, খুবই অপ্রত্যাশিত, নির্মম ও বিবর্ণভাবে।

গত মাসের প্রথম থেকে শান্তিপূর্ণভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তবে শেখ হাসিনার একটি বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।

এরপর ছাত্র জনতার ডাকে রাস্তায় নেমে আসে দেশের লাখ লাখ জনতা। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং হাসিনা পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।

তার পদত্যাগের তিন দিনের মাথায়, গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখনও ভবিষ্যত নিয়ে চলছে অনিশ্চয়তা। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশাল চ্যালঞ্জ রয়েছে।

তবে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে বৈচিত্র থাকায় তাদের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। অন্তর্বর্তী সরকারের অস্থায়ী প্রকৃতির। ক্ষমতা নেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও, দেশের প্রয়োজনে, ৮৪ বছর বয়সী ইউনূসের এখন বড়-বড় পরিবর্তনগুলো অনুসরণ করে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।

নিক্কেই এশিয়ার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূস এক কিংবা দুই বছর তার সরকার স্থায়ী করতে পারেন। কেননা তাকে সংস্কারের একটি ধারাবাহিক প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তারপর দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে।’

বাংলাদেশের রাজনীতির হঠাৎ এমন পরিবর্তনে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ভারত। কারণ- দেশটি বাংলাদেশের সবচেয়ে নীকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ। সাম্প্রতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ভারত ভালোই বেকায়দায় পড়েছে। কেননা, গত ১৫ বছরে এক্স প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সমর্থক ছিলো ভারত।

তবে ৫ আগস্টের পর সকল হিসাব নিকাশ পাল্টে গেছে বিদ্যুৎ গতিতে। ভারত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভয়াবহ রকমের চিন্তায় পড়ে গেছে। এমনকি নয়াদিল্লিতে সংসদ অধিবেশনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

এরপর বাংলাদেশের মতো ভারতেও একই পরিস্থিতি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদ। তার এমন মন্তব্যকে ঘিরে তোলপাড় চলছে দেশটির রাজনীতিতে।

বাংলাদেশের জনগণের মতে ‘স্বৈরাচারী’ নেতাকে এভাবে অন্ধভাবে সমর্থন করে ভালোই বিপাকে পড়েছে দিল্লি। কেননা হাসিনার প্রতি ক্ষোভ থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনমনে ভারত বিরোধীতা কতটা প্রকট হয়েছে। এক্ষেত্রে দিল্লিকে এখনই সাবধান হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং তার জনগণের ইচ্ছার ওপর।

দিল্লিতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে বিদেশী হস্তক্ষেপ দ্বারা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন। তাদের মতে, বিদেশী কোনো শক্তি এই গণঅভ্যুত্থানে ইন্ধন যুগিয়েছে।

তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ভরতের এসব প্রোপাগণ্ডা সত্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। কেননা শেখ হাসিনার প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ হচ্ছে তিনি বাংলাদেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।

দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে কোনো শাসক এভাবে দেশ পরিচালনা করেনি যেভাবে হাসিনা করেছেন- এমনটাই বলা হয়েছে নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে। তার আমলে গুম, খুন খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা তীব্র ভারত প্রীতি থাকলেও, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজের অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। হাসিনা সরকারের ভারত প্রীতির পরেও, তারা চীনের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। যেখানে চীন এবং ভারত নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে।

তবে, ক্ষমতাচ্যুত হবার কয়েকদিন আগে এক্স প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়েও ছিলো বিতর্ক। অনেকের মতে, চীন থেকে আশানরুপ অর্থ সহায়তা পাননি তিনি।

অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো শেখ হাসিনা সরকারের গণতান্ত্রিক ত্রুটি, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে বিশেষ নজর দেয়। এমনকি, ক্ষমতায় থাকার শেষ কয়দিন ছিলো বেশ কঠিন। বিশেষকরে,আন্দোলন দমনে বাংলাদেশে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে জানিয়ে খোলা চিঠি দিয়েছিলো দাতব্য সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব।

অন্যদিকে, জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইউনিসেফ। এছাড়াও বাংলাদেশে আন্দোলনের সমর্থনে রেমিট্যান্স বর্জন নিয়ে সরব ছিলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

এমন পরিস্থিতিতে, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দেশটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কারকে প্রাধান্য দেয়া। সেই সাথে, বিভিন্ন দাতা দেশগুলোর সাথে সম্পূর্ণ নতুনভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো।

যেহেতু পশ্চিমারা ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সমর্থন করেছে, তাই পোশাক খাতকে শক্তিশালী করতে তিনি যথেষ্ঠ সহযোগীতা পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

এছাড়া, ঢাকা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি আঞ্চলিক সম্পর্ক পুননির্মাণেও মনযোগী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সাথে, চীন ও জাপানের সাথেও নতুন নীতি অনুযায়ী সম্পর্ক উন্নয়ন করবে বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশে এখন রিজার্ভ ঘাটতি রয়েছে। তাই, ড. ইউনূস এখন স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আর্থিক সহায়তা সন্ধান করবেন বলে ধারণা নিক্কেই এশিয়ার।

এছাড়াও ‘মিয়ানমার’ অন্তর্বর্তী সরকারের বৈদেশিক নীতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার আর্মির ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে উতপ্ত মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডার। রোহিঙ্গা সমস্যাগুলোসহ মানবিক বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয় সমাধান খুঁজতে হবে।

শেখ হাসিনার অধীনে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল প্রধানত ক্ষমতায় থাকার একটি হাতিয়ার। বিগত বছরগুলোতে দক্ষতার সাথে, তিনি নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য। তবে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এখন বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে পুনঃস্থাপন ও অগ্রসর করার সুযোগ রয়েছে; কোনো একক ব্যক্তি বা দল জন্য নয়।


/এআই



সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply