‘দ্য গ্রেটেস্ট ফেনোমেননে’র জন্মদিন আজ

|

ছবি: সংগৃহীত

রাকিবুল ইসলাম মিতুল:

ইংরেজি “Phenomenon” শব্দটার বাংলা অর্থ জানেন? ‘বিস্ময়কর বস্তু, ব্যক্তি বা ঘটনা’। ফুটবল বিশ্বের কাছে রোনালদোও ছিলেন এমন একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি বা ঘটনা। যে কিনা নিজের যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়ে অবাক করেছেন ফুটবল বিশ্বের সবাইকে, অর্জন করেছেন সবকিছু। সর্বকালের সেরা ফুটবলাদের কথা আসলে তর্ক হতে পারে। কিন্তু ‘সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার’ এর প্রসঙ্গ আসলে তাকে বিতর্কিত-হীন ভাবে সবার সেরা বলা যায়। সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন রোনালদো, দ্য ফেনোমেনন।

১৯৭৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো শহরে জন্ম রোনালদো লুইস নাজারিও ডি লিমার। রোনালদোর পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। এতটা দরিদ্র ছিল যে, জন্মের পর তার নাম রেজিস্ট্রেশন করতে দুই দিন অপেক্ষা করতে হয় বাবা-মাকে। তবে রোনালদোর জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে ১১ বছর বয়সে। পরিবারের দারিদ্র্য যখন চরম শিখরে, জীবনের সবচাইতে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে, তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়!

অর্থনৈতিক সমস্যায় তাই বাদ দিতে হয় লেখাপড়াও। দু-মুঠো খাবারের তাগিদে রোনালদো স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। হ্যাঁ, এই ছোট্ট বয়সেই অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নেন রাস্তায় রাস্তায় ফুটবলের প্রতিযোগিতা চালানো। বেঁচে থাকার তাগিদে ফুটবলের মধ্যেই ভালোবাসা খুঁজে পান। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই রোনালদো হয়ে যান স্থানীয় ক্লাবগুলোর নিয়মিত সদস্য। একসময় স্থানীয় ক্লাব সাও ক্রিস্তোভাওয়ে খেলার সময় ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগের বিখ্যাত ক্লাব ক্রুইজেরোর নজরে আসেন। জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় এখানেই। এরপর ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথীবির বিখ্যাত সব ক্লাবে। সফলতার সঙ্গেই শেষ করেছেন সেসব পাঠ।

১৬ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলের অভিষেক ম্যাচেই করে বসেন পাঁচ গোল, প্রথম ম্যাচ দিয়েই চলে আসেন লাইম লাইটে। ওই মৌসুমেই সেরা গোলদাতা হয়ে ক্লাবকে ট্রফি জেতান। সেখানে ৪৪ ম্যাচে ৪৪ গোল করে নায়ক বনে যান তিনি। এরপর পাড়ি জমান ডাচ ক্লাব পিএসভিতে। সেখানেও ৫৭ ম্যাচে ৫৪ গোলের অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়েন। এরই মধ্যে রোনালদো নাম লেখান ব্রাজিলের জাতীয় দলে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে সেইসময়কার ১৯.৫ মিলিয়নের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে পাড়ি জমান বার্সেলোনাতে। ২০ বছর বয়সী একটা ছেলের গতি, ড্রিবলিং, টেকনিক, বল কন্ট্রোল দেখে তখনকার ফুটবল বোদ্ধারা রীতিমতো তাকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসাতে শুরু করে। কাতালানদের হয়ে ৪৯ ম্যাচে ৪৭ গোল করে সেই বছরেরই সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ফিফার বর্ষসেরার খেতাব জিতে নেন।

মাত্র এক সিজন বার্সায় কাটিয়ে আবারো রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে পাড়ি জমান ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে। দিয়েগো ম্যারাডোনার পর প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে ক্লাব পরিবর্তন করেন রোনালদো। সেখানেও গোলের পর গোল করে সেই বছরেই সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে জিতে নেন ব্যালন ডি’র। মাত্র ২১ বছর বয়সে বিশ্বকাপ, ব্যালন ডি’র, ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারসহ প্রায় সব খেতাবই জিতে নেন। তখনই সবাই বলাবলি শুরু করলো না জানি আর কত রেকর্ডই ভাঙবেন তিনি।

কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে বিপত্তি। ইনজুরির কারণে ৫ মাসেরও বেশি সময় খেলার বাইরে থাকতে হয়। সবাই ভেবে নিয়েছিলো এই বুঝি রোনালদোর ক্যারিয়ার শেষ। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে ঠিকই ফিরে আসেন রোনালদো। খেলার ধরণ পরিবর্তন করে ২০০২ সালে ঠিকই ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতান। সেই আসরে ৮ গোল করে গোল্ডেন বুটটাও নিজের করে নেন।

এরপরই পাড়ি জমান রিয়াল মাদ্রিদে। ৪৬ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফিতে ইন্টার মিলান থেকে তাকে রিয়াল মাদ্রিদে আনে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রিয়াল মাদ্রিদের ফ্যানরাও তাকে রাজার মতো করে বরণ করে নেয়। বারবার ইনজুরিতে পরার পরও হতাশ করেননি মাদ্রিদ সমর্থকদের। ১৯৪ ম্যাচে ১১৮ গোল করে ঠিকই নিজের জাত চেনান। জিতেন ২০০৩, ২০০৭ সালের লা লীগার শিরোপা।

২০০৯ সালে এসি মিলানের হয়ে সময়টা একদমই ভালো কাটেনি রোনালদোর। ইনজুরির কারণে বারবর মাঠের বাইরে থাকতে হয়। ছিলেন না নিজের সেরা ছন্দেও। ২০ ম্যাচে মাত্র ৯ গোল করেন তিনি। বারবার ইনজুরিতে পরে রোনালদোর ক্যারিয়ার অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি বারবারই সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ঠিকই ফিরে এসেছেন নতুন উদ্যমে। ২০০৯ সালে ফিরে যান নিজ দেশে। সেখানে করিন্থিয়ান্সের হয়ে ৫৫ ম্যাচে ৩০ গোল করেন।

পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে রোনালদো ২ টা বিশ্বকাপ, ৩ টা ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার, ২ টা ব্যালন ডি’র, ২ টা কোপা আমেরিকা, ১ টা ইউরোপা লীগের শিরোপা, বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল, ১ টা ইউরোপীয়ান গোল্ডেন বুট, ৪ টা বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাবসহ জিতেন আরো অসংখ্য পুরস্কার। ক্যারিয়ারে একমাত্র আক্ষেপ বলতে একবারও চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতেননি তিনি। তবে সেই এক শিরোপার অপূর্ণতায় তো আর তার গ্রেটনেসকে থামাতে পারেনি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে মিরোস্লাভ ক্লোসার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ডটি তার(১৫)। এছাড়াও পুরো ক্যারিয়ারে জিতেছেন ২০ টিরও বেশি শিরোপা। ৭১৫ ম্যাচে করেছেন ৪৯০ টিরও বেশি গোল। যেনো স্বপ্নের মতোই কাটে তার ক্যারিয়ার। 

কিন্তু এতো সুখ বোধহয় তার কপালে ছিল না। বারবারই ইনজুরির কারণে মাঠে বাইরে থাকতে হয়েছিল। ইনজুরিতে পরে অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ায় বারবার সমালোচনা আর কটু কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এর মধ্যেই খেলা চালিয়ে গেছেন। দিয়েছেন নিজের সেরাটা। কিন্তু ইনজুরি আর অতিরিক্ত ওজনের কারণে মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই নিজের বুটজোড়া তুলে রাখেন চিরদিনের জন্য।

মেসিকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তার চোখে সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার কে? কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই মেসি সেদিন অকপটে বলেছিলেন-রোনালদো নাজারিও। সাথে আরো বলেছিলেন, আমি তার বিপক্ষে খেলতে পেরে ভাগ্যবান। আরো ভাগ্যবান এই জন্য যে আমি যখন খেলেছি তখন তিনি ইনজুরির কারণে তার সেরা ফর্মে নেই। কারণ তিনি শুধু সেরা নাম্বার নাইন না, সর্বকালের সেরা তালিকাতেও উনি সামনের দিকেই থাকবেন।

রোনালদো আসলে কতটা ভয়ংকর ছিলেন তা বোঝা যায় তৎকালীন সময়ের সেরা ডিফেন্ডার-গোলরক্ষক ও কোচদের কথাতেই। ইতালির কিংবদন্তি ডিফেন্ডার পাওলো মালদিনি তার সেরা তিন ফুটবলারের তালিকায় রেখেছেন এই ব্রাজিলিয়ানকে। ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকবার রোনালদোকে আটকানোর ভার পাওয়া মালদিনি বলেন, রোনালদোকে আটকানো অসম্ভব। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে রোনালদোর কাছে হার মানা জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কান রোনলদোর জার্সির সঙ্গে ছবি তুলে ক্যাপশন দিয়েছিলেন ‘আমার দুঃস্বপ্ন।’

জলাতান ইব্রাহিমভিচ তো ফুটবলের ‘গ্রেটেস্ট এভার’ হিসেবেই মানেন রোনালদোকে। অহংকারী বলে দুর্নাম থাকা ইব্রা সহজে কাউকে প্রশংসা করার লোক নন, কিন্তু এই এক জায়গায় তার মুগ্ধতা প্রকাশে কখনোই পিছপা হননি তিনি। ব্রাজিলের কংবদন্তির সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, আমার জন্য , রোনালদোই ফুটবল, যেভাবে তিনি নাচাতেন। কোনো সন্দেহ ছাড়াই তিনি ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়।

স্প্যানিশ কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক বলেন, রোনালদোর বিপক্ষে খেলার সময় তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা না করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করাই উত্তম। কারণ, রোনালদো চাইলে দুনিয়ার যেকোনো পরিকল্পনা বা মার্কিং ভাঙতে পারে।

গোটা একটা প্রজন্মকে তিনি কিভাবে প্রভাবিত করেছেন তার একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করা যাক। ২০০২ সালে ফাইনালে যে তিনি চুলের সামনে অদ্ভুত ছাঁট দিয়েছিলেন সেটি অনুকরণ করে সারা বিশ্বে লক্ষ কোটি তরুণ অবিকল রোনালদোর মতো চুলে ছাঁট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাদ যায়নি তার বাংলাদেশি ফ্যানরাও। ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের ব্রাজিলিয়ান বেশ কিছু ভক্তের চুলেও দেখা যায় রোনালদোর মতো কাট। তাই গোটা একটা প্রজন্মের অনুপ্রেরণা ছিলেন এই রোনালদো। হ্যা, ইনিই সেই রোনালদো, দ্য গ্রেটেস্ট ফেনোমেনন।



সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply