নিজ দেশ থেকে প্রবাসে যেতে হলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হয় বাংলাদেশিদের। অথচ অনেকগুলো দেশে যাওয়ার জন্য খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে সেই সুবিধা পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করে যেতে হ প্রবাসে। এরপর মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের মাধ্যমে গিয়ে মেলে না কাজ। এতে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের। যুগ যুগ ধরে এমনটি চলে আসলেও কোনো সুরাহা হচ্ছেই না এসব সমস্যার। সরকারিভাবেও তেমন জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রবাসী কর্মীদের দুর্ভোগও কমে না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এ বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে যমুনা টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘২৪ ঘণ্টা’য় আলোচনা হয় ‘অভিবাসন খাতের নানা সম্ভাবনা ও সংকট’ বিষয়ে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সাবেক পরিচালক ড. মো. নুরুল ইসলাম, ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান।
এ সময় প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের কর্মীরা যত টাকা খরচ করে যান তার তুলনায় অনেক কম আয় করেন। আবার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি কর্মীদের প্রবাসে যেতে বেশি খরচ করতে হয়। এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হয়েছে? এই সংকটের পেছনে কারা, সিন্ডিকেটেই বা কারা?
জবাবে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, এই দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েছে কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী ও প্রবাসী শ্রমিকরা। এক কোটি প্রবাসী বছরে ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। আমরা বৈশ্বিক যে ঋণ পাই, তার সাত থেকে আট গুণ বেশি ডলার পাঠায় এই প্রবাসীরাই। যারা এই অর্থনীতির ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছে, তাদের কোনো সম্মান বা মর্যাদা নেই। সবচেয়ে বেশি এই প্রবাসীরাই বৈষম্যের শিকার হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামুলক কম দূরত্ব হলেও এখান থেকে বিমানের টিকিট খরচ বেশি। প্রতিটি ধাপে ধাপে কর্মীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয়। সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাবমতে, একজন প্রবাসী যে টাকা খরচ করে বিদেশ যায়, সেই খরচের টাকা তুলতেই তার আঠারো মাস চলে যায়। মানুষ ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে রাজি কিন্তু ১০ হাজার টাকা খরচ করে ট্রেনিং নিতে রাজি না। আমাদের কর্মীরা দক্ষ না। যে যত বেশি দ্ক্ষ হবে, তার কাজ পাওয়া তত সোজা ও বেতন বেশি। দ্বিতীয় হচ্ছে, ধাপে ধাপে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে টাকা চলে যায়। সরকারের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সংকট, এসব কারণেই বাংলাদেশ থেকে খরচ বেশি হয়। এর ফলে প্রবাসীদের ধাপে ধাপে নানা সংকটে পড়তে হয়।
এ সময় বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন করা হয়, সিন্ডিকেট বহালই থেকে যাচ্ছে। এটি কেন ভাঙা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এই সেক্টরে এত অনিয়ম থাকলেও সরকারের উপযুক্ত নজরদারি থাকে না। ১৯৯২ সালে কোরিয়ায় লোকবল পাঠানোর নামে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সিন্ডিকেট তৈরি হয়। এরপর এটি ভাঙা যায়নি, বরং ধীরে ধীরে গন্তব্য দেশের সিন্ডিকেট বেড়েছে। এটি ভাঙার জন্য আমাদের সরকার ও গন্তব্য দেশের পলিসি মেকারদের মধ্যে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। উভয় দেশেই সরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, অভিবাসন খাতটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা দালাল নির্ভর হয়ে গেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ সরাসরি রিক্রুট এজেন্সির কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ, প্রবাসে যারা যাচ্ছেন তারা সবাই গ্রামে থাকেন। আর রিক্রুট এজেন্সিগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে এই মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা দালালদের শরনাপন্ন হন প্রবাসে পাড়ি জমাতে ইচ্ছুকরা। ফলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পেটে বড় অঙ্কের টাকা ঢুকছে। তিনি বলেন, এটি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে তথ্য সেন্টার তৈরি করতে হবে। যেখান থেকে মানুষ কোন দেশে যেতে হলে কোনো এজেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে এসব তথ্য পাবে। এছাড়া প্রবাস সংক্রান্ত সব তথ্য তার থেকে নিতে পারবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সাবেক পরিচালক ড. মো. নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এত বছরেও কেন সরকার এই খাতকে সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারেনি? এসবের সমাধান কেন করা যায় না?
তিনি বলেন, প্রবাসে যেতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। একটি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি যদি একজনকে নেয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয়, তাহলে দেখা যায় অনেক মানুষ যেতে আবেদন করছে। ফলে এই জায়গাটির সুযোগ নেয় এজেন্সিগুলো। বলেন, ৫-৬ লাখ টাকা নেয়া হলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা বেশি টাকা পায় না। তারা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পায়। টাকা যায় মূলত ভিসা কেনা-বেচার সময়। ভিসা কিনতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয় কমাতে না পারলে অভিবাসন ব্যয় কমানো সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
নুরুল ইসলাম বলেন, ১৯৩টি দেশে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যায় মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে। এই দেশগুলোতে ভিসা কেনা-বেচা হয়। কারণ এসব দেশগুলোতে আমাদের কর্মীদের বিশাল চাপ রয়েছে। সেই চাপকেই সুবিধাভোগীরা কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নেয় বলেও জানান তিনি।
/এনকে
Leave a reply