মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও প্রণয়ন করা হয়নি। নিশ্চিত পরাজয় জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
কিন্তু ৪৭ বছর কেটে গেলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়নি। গত বছরের জুলাইয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা বই আকারে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা এ বিষয়টি এখনও সুনির্দিষ্টকরণ হয়নি। ফলে সারা দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম চলছে। এটি শেষ হলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দেয়া হবে।
২০১৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানীর রায়েরবাজারে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, আশা করি আগামী জুলাইয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাব। জেলা পর্যায় থেকে এ তালিকা সংগ্রহের কাজ চলছে। আগামী জুলাইয়ে এর গেজেট হবে। এর আগে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছিলেন, সরকারের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা নেই। এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, সঠিক তালিকা মন্ত্রণালয়ে নেই। তবে সঠিক তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জুনের মধ্যে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে। তবে এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, জেলা প্রশাসন ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ ও লালন করে তাদের মাধ্যমে জেলাভিত্তিক তালিকা সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সব জেলা প্রশাসন তাদের তালিকা পাঠায়নি। আবার কিছু জেলা থেকে নামের তালিকা এলেও ওইসব নামের বিষয়ে নানা মত রয়েছে। এ তালিকায় গণহারে নিহত ব্যক্তির নামও রয়েছে। এ কারণে বিষয়টির কোনো অগ্রগতি নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, তার জানা মতে সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। সরকারের ওপর ভরসা করে কোনো লাভ হবে বলেও তিনি মনে করেন না। অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে তালিকা করেছেন। এ বিষয়ে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তবে সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা থাকা উচিত।
যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে সে সময় জাতি কাদের হারিয়েছিল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির যুগান্তরকে বলেন, বুদ্ধিজীবী কারা সেটির কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ না থাকায় মূলত এ তালিকা করা খুব জটিল।
সরকারের জন্য এটি চ্যালেঞ্জও বটে। এ তালিকা করার পাশাপাশি সরকারের উচিত ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার করা। যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা তৈরি করে এবং তাদের সংগঠনের বিচার করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’র সভাপতি মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা অনেক আগে করা উচিত ছিল। তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা জাতির ‘আইকন’। তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের বিষয়ে জানাতে অবশ্যই এ তালিকা তৈরি করতে হবে।
প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানায়। সরকারি তালিকা ছাড়া কিসের ভিত্তিতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়- জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা না থাকায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠনগুলোর দেয়া তালিকা অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণপত্র পান যারা : বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে ৬১ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরিবারগুলোর উল্লেখযোগ্যরা হলেন- শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমদ, আবুল খায়ের, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ডা. আজহারুল, ডা. আমিন উদ্দিন, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ার, কাজী শামসুল হক, আনোয়ার পাশা, মধুসূদন দে (মধুদা), শেখ আবদুস সালাম, সার্জেন্ট শামসুল করিম খান, অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদার, প্রকৌশলী লে. কর্নেল আবদুল কাদির, আবুল হাসেম মিঞা, প্যারী মোহন আদিত্য, সৈয়দ সুলতান হোসেন, জসিমুল হক, আজিজুর রহমান, কাজী আবু বকর সিদ্দিকী, সিকদার হেমায়েতুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম চান্দ, ডা. গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, আবদুল মুকতাদির, ডা. কর্নেল এএফ জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন আলমগীর, আবদুর রহমান, শাহ আবদুল মজিদ, মামুন মাহমুদ, জিয়াউল হক খান লোদী, কবি মেহেরুন্নেছা, ক্যাপ্টেন একেএম ফারুক, মহিবুল্লাহ (বীরবিক্রম), কাজী আবদুস সামাদ, অশ্বিনী ঘোষ, অমূল্য রঞ্জন দাস, নাসির উদ্দিন আহমেদ, সত্য রঞ্জন সরকার, রুহুল আমীন (বীরবিক্রম), সিরাজুল হক চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, ফয়জুর রহমান, রাশীদুল ইসলাম, মো. সলিমুল্লাহ, আবদুস সাত্তার, নিজাম উদ্দিন, জালাল উদ্দিন আখন্দ, মনিরুল ইসলাম আখন্দ, জগৎ ভূষণ দত্ত, নূর মুহাম্মদ, শিহাবুদ্দীন শেখ, একেএম মুনিরুজ্জামান, চানধন সুর ও মুকসদ আলী। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করতে শুরু করে। তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করে। সে তালিকা অনুযায়ী ১১ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের আটক করা। তাদের হাত-পা-চোখ বেঁধে গোপন স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে তাদের মরদেহ ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আবর্জনার মধ্যে ফেলে রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর বুদ্ধিজীবীদের নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পান।
স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মতান্তরে ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
(সূত্র: দৈনিক যুগান্তর)
Leave a reply