নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলার বিমান দুর্ঘটনার জন্য পাইলটের ‘মানসিকভাবে অস্থির অবস্থায় দিকভ্রান্ত হওয়া এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাবকে’ দায়ী করেছে নেপালের তদন্ত কমিটি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমনটি জানানো হয়েছে।
বিমানটি অবতরণের সময় কন্ট্রোল টাওয়ার ও বিমান কর্মীদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তিকেও সম্ভাব্য কারণগুলোর অংশ বলে মনে করছে কমিটি। নেপালের গঠিত কমিটি তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে।
তবে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ নেপালের এই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশেষ করে পাইলটের ‘ব্যক্তিগত ভুল’ বিষয়ে দেয়া তথ্যের প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাইলটের ভুল হতেই পারে, কিন্তু নেপাল কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্ব ছিলো আরো বেশি। তারা সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্ঘটনার সময় নেপাল কন্ট্রোল টাওয়ারে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলো বলেও জানানো হয়েছে।
গত বছরের ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান।
ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ছিলেন সে দিনের ওই ফ্লাইটের পাইলটের দায়িত্বে। তার সঙ্গে কো-পাইলট হিসেবে ছিলেন পৃথুলা রশিদ। দুর্ঘটনায় তারা দু’জনসহ বিমানের মোট ৫১ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। ২০ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের অনেকের আঘাত ছিল গুরুতর।
এরপর এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে নেপালের কর্তৃপক্ষ। রোববার ওই কমিটি তাদের ৪৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দেশটির পর্যটন ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে।
নেপালের সাবেক সচিব যাজনা প্রাসাদ গৌতমের নেতৃত্বে ওই কমিশনে নেপালের নানা বিভাগের কর্মকর্তারা ছিলেন। এর বাইরে বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমাতুল্লাহ এবং নকশা ও নির্মাতা পরামর্শক হিসেবে কানাডার নোরা ভেল সহায়তা করেছেন।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ৪৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার সময় বিমানটি যিনি চালিয়েছেন, একজন প্রশিক্ষক হিসেবে তার বিষয়ে একজন নারী সহকর্মীর অভিযোগের কারণে আবেগ তাড়িত এবং মানসিক চাপের মধ্যেই বিমানটি চালাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি নিরাপত্তা গাইডলাইন লঙ্ঘন করে ককপিটে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, রাডার ব্যবহার করে রানওয়ে না দেখে বা যথাযথ প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন না করেই বিমানটি অবতরণ করার উদ্যোগ নেয়।
‘রানওয়ে দেখার পর থেকেই নিছক বেপরোয়া মনোভাব থেকে পাইলট খুব কাছাকাছি এবং স্বল্প উচ্চতা থেকে বিপদজনকভাবে বিমানটি অবতরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও সে রকম কোনও চেষ্টা দেখা যায়নি।’ বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার ও ক্রুদের যোগাযোগের সমস্যাকেও দায়ী করা হয়েছে। ককপিটের ভয়েস রেকর্ডার তথ্য থেকে জানা গেছে, রানওয়ে ০২ নাকি ২০তে বিমানটি অবতরণ করবে, তা নিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ার ও বিমান কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির তৈরি হয়েছিল।
দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে যে সব বিষয়কে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে:
* বিমান উড্ডয়নে আগে যে ব্রিফিং করা হয়েছে, তার সময় যথার্থ ছিল না। কারণ বিমানটি দুপুরে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও পাইলটকে ব্রিফ করা হয়েছে সকালে। এর মাঝে আরো চারটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও ছিল।
* যিনি বিমানটি চালাচ্ছিলেন, সেই পাইলট আরেকজন নারী সহকর্মীর আচরণের কারণে মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন বলে মনে হয়েছে এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানোর সময় পাননি।
* রানওয়ে ২০তে অবতরণের ক্ষেত্রে কম্পিউটার ‘সিমুলেটর’-এ আগে প্রস্তুতি নেনটি বিমান ক্রুরা।
* বিমান কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের দুর্বলতা।
* নিয়ম মেনে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে ব্যর্থতা
* বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ার যে নামানো হয়নি, সেটা যথাসময়ে দেখা হয়নি।
* একই সময়ে বিমান চালনা এবং টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করায় পাইলটের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া।
* ক্রুদের রানওয়ে ঠিকভাবে দেখতে না পারা এবং রানওয়ের সমান্তরালে বিমানটি আনতে না পারার পরেও পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হওয়া।
* অতিরিক্ত গতি, রাডার তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে মূল ল্যান্ডিং গিয়ারটি রানওয়েতে যথাযথভাবে নামাতে না পারা।
* পুরো প্রক্রিয়ার সময় গতি, উচ্চতা এবং বিমানের অন্যান্য নির্দেশকগুলো নজরদারি না করা।
* বিমানটির যাত্রাপথের ওপর কাঠমান্ডুর কন্ট্রোল টাওয়ারে নজরদারির ঘাটতি ছিল এবং একটি মিসড অ্যাপ্রোচ প্রসিডিউর অনুসরণ করার কোনও নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।
* রানওয়ে প্রসঙ্গে বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার এবং বিমান ক্রুদের মধ্যে যোগাযোগের পরিষ্কার ভুল বোঝাবুঝি। বিমানটি কোন দিক থেকে রানওয়েতে অবতরণ করবে তা নিয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে।
* বিমানবন্দরের ক্রুদের তাদের অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক করতে কন্ট্রোল টাওয়ারের ব্যর্থতা।
গত বছরের ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বম্বার্ডিয়ার ড্যাশ এইট কিউ-৪০০ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি শেষ মুহূর্তে অবতরণের গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল। বিমানটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার ছয় সেকেন্ডের মাথায় এটিতে আগুন ধরে যায়। মূলত আগুনে পুড়েই মারা যান বেশিরভাগ আরোহী।
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই দুর্ঘটনা ছিল ১৯৯২ সালের পর নেপালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে ওই বিমানবন্দরেই পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৬৭ জন। এর মাত্র দুই মাস আগে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানও বিধ্বস্ত হয় সেখানে। সেই ঘটনায় নিহত হন ১১৩ জন।
নেপালের বিমান চলাচল নিরাপত্তার মান খুবই দুর্বল বলে মনে করা হয়। মূলত রক্ষণা-বেক্ষণের দুর্বলতা এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনাকেই এর জন্য দায়ী করা হয়।
দুর্বল নিরাপত্তা মানের কারণে নেপালের এয়ারলাইন্সগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের আকাশসীমায় উড্ডয়নের অনুমতি পায় না।
নেপালের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে ত্রিভুবন বিমানবন্দর। পাহাড়ের উপত্যকায় এই বিমানবন্দরটি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি।
Leave a reply