জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ হালনাগাদ করে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ‘বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোন অসত্য ও বিকৃত তথ্য বা অসৌজন্যমূলক বার্তা’ প্রকাশ না করা সংক্রান্ত দুটি ধারা নতুন যুক্ত করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার এর বিধান রাখা হয়েছে। নতুন যুক্ত হওয়া দুটি ধারাকে অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৩২ ধারা এবং আইসিটি আইনের অধুনালুপ্ত ৫৭ ধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এটিকে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে সাংবাদিকতা বাঁধার মুখে পড়বে বলে সাংবাদিকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
প্রশাসনসূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা বিধিকে ‘দুর্বল ও সেকেলে’ উল্লেখ করে তা হালনাগাদের পরামর্শ দেয়। শৃঙ্খলা বিধির প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করতে ওই বছরের ১৬ মে তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আবুল হোসেনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির হালনাগাদ করা শৃঙ্খলা বিধি গত ০৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাদেশ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে।
অধ্যাদেশের ৫ এর ঞ) নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোন সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।
৫ এর থ) নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ছাত্র/ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশ্যে টেলিফোন, মোবাইল, ই-মেইল, ইন্টানেটের মাধ্যমে কোন অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্যক্ত করবে না।
কোন শিক্ষার্থী এ জাতীয় কোন কাজ করলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে। এজন্য লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার উর্দ্ধে যেকোন পরিমাণ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, ‘নতুন ধারায় শাস্তির বিধান রাখায় সাংবাদিকরা ভয়ে থাকবে। কেননা যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারাই সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করবেন। এর ফলে সাংবাদিকদের অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি লাভবান হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হবে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বত্রই টুটি চেপে ধরা হচ্ছে।’
বিতর্কিত ধারা বাতিল করার দাবি জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. মুসা বলেন, ‘সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধ করতেই ধারা দুটি যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি যাতে সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য চাপে রাখার কৌশল এটি।’
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা রুদ্ধ হবে জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউন- এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. সোয়াইব রহমান সজীব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমাদের সোর্সের ওপর নির্ভর করতে হয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনও প্রতিবেদনের তথ্য মিথ্যা দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি তদন্ত কমিটি গঠন করে তখন সেখানে আমাকে সোর্স প্রকাশে বাধ্য করা হবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে সোর্সও ভয়ে তথ্য দিবেন না। আর সোর্স প্রকাশও সাংবাদিকতার নীতি- নৈতিকতাবিরোধী। ফলে তথ্যপ্রাপ্তির সকল পথ বন্ধ করে সাংবাদিকদের কোনঠাসা করে রাখার প্রক্রিয়া এটি।’
এদিকে নতুন তৈরি করা ছাত্র শৃঙ্খলা বিধিকে দুরভিসন্ধিমূলক, স্বেচ্ছাচারী, অগণতান্ত্রিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সোমবার দুপুরে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দুরভিসন্ধিমূলক ধারা বাতিলের দাবী জানিয়ে বলা হয়, ‘মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আইন দিয়ে রুখতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এই আইন আরো বেশি ভয়ংঙ্কর। এটি রাষ্ট্রের বহু আলোচিত ৫৭ ধারারই নামান্তর। রাষ্ট্র যেমন একক ভাবে সকলের স্বাধীনতাকে চেপে ধরছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও ঠিক সেই পথেই হাটছে।’
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেন বলেন, ‘নতুন বর্ষের প্রবেশিকা অনুষ্ঠান সামনে থাকায় বেশ তাড়াহুড়া করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ সেভাবে পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। তবে কোনও পক্ষের আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে।’
Leave a reply