আগামী ১ জুলাই একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়নি। ফলে যথাসময়ে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা তিনটি বই ছাপা ও বাজারজাতের কাজ দেয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবার অগ্রণী প্রিন্টার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দিয়েছে। তারা শনিবার পর্যন্ত কাজ শুরু করেনি। অথচ একই কাজ গত বছর ১৭টি প্রতিষ্ঠান এক মাস আগে শুরু করেছিল।
তারপরও ১ জুলাই বাজারে বইয়ের স্বাভাবিক সরবরাহ ছিল না। এবার একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশের বাজারে বই পৌঁছানো নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পহেলা জুলাইয়ের আগে পৌঁছানো নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা নকল বই কেনার দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যুগান্তরকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারে কাজ চলছে। এতে যদি কোনো সমস্যা বা সংকট থাকে তবে তা দেখা হবে। উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো। এনসিটিবি এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা। এ নিয়ে কোনো সমস্যা আছে বলেও আমাদের অবহিত করা হয়নি। তবে এক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
পাঠ্যবই মুদ্রণ সংশ্লিষ্টদের দাবি, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই নিয়ে এবার এনসিটিবির দু’জন এবং সচিবালয়ের একজনসহ তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। রহস্যজনক কারণে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ওই সিন্ডিকেট একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানকে সব বইয়ের কাজ দিয়েছে। এছাড়া কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ সক্ষমতাও বিবেচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সম্ভাব্য সংকট সামনে রেখে মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা এনসিটিবিকে বৃহস্পতিবার সতর্ক করেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এই স্তরের বই ছাপতে লাগে ৫ দিন আর ক্লাস শুরু হতে এখনও বাকি আছে ১৫ দিন। সুতরাং যথাসময়ে বই বাজারজাতকরণে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না। এ নিয়ে আগাম কথা বলাও উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্তে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া বাস্তবে তাদের সক্ষমতা আছে বলেই কাজ দেয়া হয়েছে। যদি তারা বাজারে বই না পৌঁছাতে পারে, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী পরে পেনাল্টি (জরিমানা) হবে। কিন্তু এতে শিক্ষার্থী বা সরকারের কী উপকার হবে- সেই প্রশ্নের জবাব অবশ্য তিনি দেননি।
জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় তিন ডজন বিষয় (বই) পাঠ্য আছে। এগুলোর মধ্যে বাংলা, বাংলা সহপাঠ এবং ইংরেজি বই সরকারের তত্ত্বাবধানে আছে। এগুলো দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটিবি বাজারজাতের ব্যবস্থা করে থাকে। এনসিটিবির অনুমোদনক্রমে বাকি বিষয়ের পাঠ্যবই প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বাজারজাত করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর ধরে দেশের প্রকাশনা জগতের শীর্ষ ১৬-১৭টি প্রতিষ্ঠান সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা তিনটি বই ছাপা ও বাজারজাতের কাজ নেয়ার পরও ক্লাস শুরুর আগে সরবরাহ কম থাকত। এই সুযোগে একাধিক চক্র নকল বই ছেপে বিক্রি করেছে।
এতে একদিকে বেশি দামে নিম্নমানের কাগজের বই কিনতে হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। অপরদিকে লাখ লাখ টাকা রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে সরকার। এসব অতীত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এনসিটিবি এবার অগ্রণী প্রিন্টার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নোয়াখালীভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠানটির ছাপাখানাও নোয়াখালীতে। মুদ্রণ শেষে তিনটি বিষয়ের ২৭ লাখ বই বাঁধাই এবং এরপর সারা দেশে বাজারজাত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, ‘যিনি মুদ্রণের কাজটি নিয়েছেন, তিনি এই সমিতিরই সদস্য। তার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। অপরদিকে আমরা সরকার সমর্থক। সরকারের ভালো চাই। সরকারি বইয়ের যে কোনো সমস্যা ও সংকট তৈরি হলে প্রকাশক ও মুদ্রাকরদের ওপর দায় চাপে। আমরা স্পষ্ট দেখছি যে, এনসিটিবির আবেগী ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একাদশ শ্রেণীর বই নিয়ে সংকট অপেক্ষা করছে। তাই সরকার যাতে বেকায়দায় না পড়ে এবং আমাদের বদনাম না হয়, সেই তাড়না থেকে এনসিটিবিকে পরামর্শ দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা আমলে নেননি।’
এ বছর ১৭ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী এসএসসি পাস করেছে। সেই হিসাবে একাদশ শ্রেণীতে প্রতিটি বিষয়ের জন্য ১৭ লাখ বই দরকার। যদিও এনসিটিবি প্রতিটি বিষয়ে ৯ লাখ ৬০ হাজার (তিনটি বই) হিসাবে প্রায় ২৯ লাখ বই বাজারজাতের উদ্যোগ নিয়েছে। অপরদিকে ১ জুলাই ক্লাস শুরু হওয়ায় জুনের শেষ সপ্তাহে এবং জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সাধারণত রাজধানী, বিভাগীয় এবং বড় শহরের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই বই কিনে থাকে। বাকি ৪০ শতাংশ গ্রামগঞ্জের ছাত্রছাত্রীরা আস্তে-ধীরে কিনে থাকে। সেই হিসাবে প্রতিটি বিষয়ে ১১ লাখের বেশি বই দরকার দু’সপ্তাহে। কিন্তু এবার সংকট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
অবশ্য বই মুদ্রণ ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করেছেন অগ্রণী প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী কাওসার উজ্জামান। এবার তারাই কাজটি পেয়েছেন। কয়েকদিন আগে আলাপকালে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রায় ৩০ লাখ বই ছাপানোর দায়িত্ব নিয়েছি। সারা দেশে বই বাজারজাত করার চ্যানেল আমাদের আছে। আশা করছি, সব শিক্ষার্থীর হাতে ১ জুলাইয়ের আগেই বই পৌঁছাতে পারব। কোনো সমস্যা হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনসিটিবি কথা দিয়েছে যে, নকল প্রতিরোধের ব্যবস্থা করবে। আমরা আশা করছি, এবার কোনো বই নকল হবে না।
প্রসঙ্গত, উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ের নকল ঠেকাতে সরকার বিশেষ কাগজের একটি ফর্মা করে থাকে। সেই কাগজকে ‘সিকিউরিটি পেপার’ বলা হয়। এই কাগজ প্রকাশককে এনসিটিবির কাছ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু নকল বইয়ে সিকিউরিটি পেপার থাকে না। ফলে সরকার এক্ষেত্রে রাজস্ববঞ্চিত হয়। আবার এই তিনটি বই থেকে এনসিটিবি রয়্যালটি হিসেবে মূল্যের ১১ শতাংশ হারে পেয়ে থাকে। সেই হিসাবে ২৯ লাখ বই থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। বই নকল হলে এই অর্থও পাবে না সরকার।
সূত্র; যুগান্তর
Leave a reply