পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর মানুষ বসবাস করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ জন থেকে শতাধিক লোকও একেকটি ভবনে বসবাস করছে। সাত মাত্রার ভূমিকম্পে এসব ভবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও রাজউক ভবনগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায় সেরেছে। তবে কিছু পুরনো ভবন হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে ভাঙার ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জানা যায়, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, খাজে দেওয়ান, চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, কসাইটুলি, নাজিরাবাজার, কাপ্তানবাজার, সাতরওজা, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় কয়েকশ’ জরাজীর্ণ ভবন রয়েছে। এসব এলাকায় শত বছর কিংবা কয়েকশ’ বছর পুরনো জরাজীর্ণ ভবনে বংশ পরম্পরায় মানুষ বসবাস করছে। অধিকাংশ বাড়ির মালিক ভবন ভাড়া দিয়ে নিজেরা অন্যত্র বসবাস করছে। এছাড়া তুলনামূলক কম বয়সী ভবনগুলোর কোনো অনুমোদন নেই, আবার কিছু বাড়ির অনুমোদন থাকলেও পূর্বের নকশা বদলে ফেলায় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) জিওডেসেক কনসালট্যান্টস অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তালিকা করে পুরান ঢাকার ৫৭৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১৪৫টিকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে-সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি, হাজারীবাগে ২১টি, লালবাগে ৭৩টি ও শাঁখারীবাজারে ৯১টি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় পুরান ঢাকার দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ বছরের পুরনো ভবনের সংখ্যা পঁচিশটিরও বেশি।
এদিকে প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত ভবনগুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো নিয়ে কী করা হবে, সেটা পরিষ্কারভাবে কেউ বলতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘আরবান রিজিওনাল প্রজেক্ট’ ধরে কাজ করা যেতে পারে। তবে ব্যক্তি মালিকানায় থাকা পুরাতন ভবনগুলো নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। আদালতের নিষেধাজ্ঞায় এসব ভবন মেরামত কিংবা তা ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। ওইসব মালিক সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান একাধিক ভবন মালিক।
লালবাগ এলাকার হাজী আলি হোসেন নামে একজন ভবন মালিক বলেন, বাপ-দাদার ভিটা-মাটিতে থাকা বসতবাড়ি কিভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনা হয় তা বুঝি না। সবাই বাসা-বাড়ি পুরাতন হলে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু আমরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নির্মাণ কাজ করতে পারছি না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পুরনো যে তালিকা ছিল, সেটা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা পাওয়ার পর তারা ব্যবস্থা নেবেন কি নেবেন না এটা তাদের ব্যাপার। এছাড়া, রাজউক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে জনবল দরকার তা নেই। যে কারণে তালিকা থাকার পরও ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও ওপর মহলের অনুরোধ রাখতে গিয়ে তালিকায় থাকার পরও কিছু করা সম্ভব হয় না।
পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, বাস্তবে পুরান ঢাকার অধিকাংশ স্থাপনাই ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনবিধি কিংবা ইমারত নির্মাণের আইনকানুনও মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন মহলের তদবির কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাড়ির মালিকরা পার পেয়ে যান। তাদের আইন মানতে বাধ্য করার উপায় থাকে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজউক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমদ বলেন, পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণ করতে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ওইসব ভবন ভেঙে ফেলতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply