কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়ামে ক্রোয়েশিয়া ও স্পেন উপহার দিলো নক আউট পর্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা ও পরতে পরতে এড্রেনালিন রাশের উপাখ্যান। ১২০ মিনিটের উত্থান পতনে ভরা ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডের মহারণে ক্রোয়েশিয়াকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌছে গেল স্পেন। আর নির্ধারিত সময়ের শেষ পাঁচ মিনিটে দুই গোল করে প্রত্যাবর্তনের দুর্দান্ত গল্প রচনা করা ক্রোয়েশিয়া পরিণত হলো অতিরিক্ত সময়ে স্পেনের পাল্টা প্রত্যাবর্তনের নীরব দর্শকে।
নির্ধারিত সময়ে ম্যাচের প্রথম এবং শেষ দুটো গোল ক্রোয়েশিয়ার। আর মাঝখানে স্পেনের আধিপত্য। আবার অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটের খেলায় ব্যবধান গড়ে দেয়া দুটো গোলই স্পেনের। আট জনের আটটি গোলের ম্যাচে থাকে না কখনোই একক কোন নায়ক। তবে ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে লুকা মডরিচের নাম বলা যেতে পারে। দুই গোলে পিছিয়ে পড়ার পর নিচে থেকে প্রতিটা আক্রমণের বুনন তৈরি করেছেন তিনি। ওভারল্যাপ করে উঠেছেন, আবার দ্রুততার সাথে নিচে নেমে ইন্টারসেপশনে দলকে রক্ষা করা এই মিডফিল্ডারের খেলা হয়তো ইউরো আসরে আর কখনো দেখা যাবে না।
ম্যাচের ২০ মিনিটে প্রথমে এগিয়ে যাওয়ার সময়েও ক্রোয়েশিয়া নিশ্চিতভাবে তাদের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারেনি। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ডেভিড ডি হায়াকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা উনাই সিমন ব্যর্থ হয়েছেন পেদ্রির একটি নিরীহ দর্শন ব্যাকপাসকে ঠেকাতে। সমতা আনতে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করতে থাকে ধারহীন আক্রমণভাগের জন্য ইতোমধ্যে প্রচুর সমালোচনার শিকার হওয়া স্পেন। ক্রোয়েশিয়ার অর্ধে তৈরি হওয়া জটলা থেকে বার পাঁচেকের টানা প্রচেষ্টায় অবশেষে পাবলো সারাবিয়ার শট খুঁজে পায় গোলের ঠিকানা।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে ফেরান তোরেসের ক্রসে হেড করে স্পেনকে এগিয়ে দেন সিজার আজপিলিকেটা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী এই ডিফেন্ডার ম্যাচে খুব বেশি ওভারল্যাপ করে উঠেননি। কিন্তু যেবার উঠে এসেছেন ডি-বক্সে, নিশ্চিত করেছেন সেটা কাজেই লাগছে।
এবার সমতা ফেরাতে গিয়ে ডিফেন্স উন্মুক্ত করার খেসারত দেয় ক্রোয়েশিয়া। ৭৬ মিনিটে হোসে গায়া যখন বাম প্রান্ত থেকে ডান প্রান্তে ফেরান তোরেসের উদ্দেশে লম্বা বল বাড়ান তখন ফেরানের সামনে কেবল বিশাল খালি একটা জায়গা আর ক্রোয়াট ডিফেন্ডাররা নিজেদের অর্ধের অনেক উঁচুতে। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলার পরও যে গোলরক্ষক লিভাকোভিচ ৫টি গোল খেলেন তার অন্যতম কারণও ক্রোয়াট ডিফেন্সের অমনোযোগ।
কিন্তু ম্যাচের নাটকটাও মঞ্চস্থ হয় এর মিনিট দশেক পরে। ম্যাচটা শেষ হয়ে গেছে ধরে নিয়ে যারা প্রস্থানের কথা ভাবছিলেন তাদের ভুল প্রমাণ করতেই যেন মাঠে নেমে এলো রহস্যের আলোয়ান গায়ে কোনো অনিশ্চয়তার দেবতা। ৮৫ মিনিটে মিস্লাভ অরসিচের গোলে প্রাণ ফিরে পায় ক্রোয়াটরা। আর খেলা শেষের মিনিট দুয়েক আগে, ৯০+২ মিনিটে স্পেনকে স্তব্ধ করে দিয়ে ম্যাচে সমতা আনে মারিও পাসালিচের গোল।
তারপর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের জন্য আবার মাঠে নামে ক্লান্ত সবগুলো পা। কিন্তু একজনের বোধহয় প্রমাণের বাকি রয়ে গিয়েছিল অনেককিছুই। ম্যাচের ১০০ মিনিটে ডানপ্রান্ত থেকে উড়ে আসা বলকে বুক দিয়ে নামিয়ে বাম পায়ের দুর্দান্ত যে শটে গোল করলেন নিন্দিত ফরোয়ার্ড আলভারো মোরাতা, তা কেবল দেখালো যে একটি পার্ফেক্ট নাম্বার নাইন গোলের চেহারা কেমন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গোল মিসের কারণে মৃত্যুর হুমকি পাওয়া এই ফরোয়ার্ড যেন দেখিয়ে গেলেন ফুটবলারদের জীবনে চিরায়ত বিষাদের গল্পটি। যখন সফল হবেন, তখন অতি সরলীকরণের মাধ্যমে অতীতের নায়কদের আড়ালে পড়ে থাকবেন আপনি। আর যখন ব্যর্থ হবেন তখন আবারও উঠে আসবে ভিয়া, তোরেসদের মতো ফরোয়ার্ডদের সাথে তুলনা।
তার মিনিট তিনেক পরে মিকেল অয়ারজাবালের গোলে অনেকটাই নিশ্চিত হয় স্পেনের জয়। তবে এরপর দাঁতে দাঁত চেপে ডিফেন্ড করে যায় স্পেন। কারণ আরেক প্রস্থ সমতা হজম করাটা সম্ভব হতো না লুইস এনরিকের দলের জন্য। মাথা নিচু করেই তাই ইউরোর বর্ণাঢ্য আসর থেকে দল সমেত বিদায় নিলেন লুকা মডরিচ।
Leave a reply