প্রায় ৫ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্যের অপব্যবহার করেছে পরামর্শক সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এমন বেরিয়ে আসার পর সংস্থাটির পাশাপাশি ফেসবুকও বেকায়দায়। আস্থার এমন সংকট তৈরি হয়েছে যে শেয়ারবাজারে দুদিনেই হারিয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত ক্ষতি হয়তো তার চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু এমন দুর্যোগের সময় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততা যেন আরও ক্ষেপিয়ে তুলছিলো সাধারণ ব্যবহারকারীদের। অবশেষে মুখ খুললেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির স্রষ্টা, মার্ক জাকারবার্গ। বুধবার ফেসবুকে দেয়া পোস্টে খোলামেলা কথা বলেছেন বর্তমান সংকটের কারণ ও তা থেকে উত্তরণের কর্মপন্থা নিয়ে।
চলুন জেনে নেয়া যাক, কী বলেছেন জাকারবার্গ।
“২০০৭ সাল থেকে আমরা ফেসবুককে এমনভাবে সাজিয়েছিলাম যেন, অন্যান্য অ্যাপসও এর ভাগীদার হতে পারে। যেমন ক্যালেন্ডারে উঠে আসবে ফেসবুক বন্ধুর জন্মদিনের খবর, ম্যাপে দেখাবে কোন বন্ধু কোথায় রয়েছ, বন্ধুদের ছবি দেখা যাবে অ্যাড্রেস বুকে। এর জন্য অ্যাপসগুলোতে লগ ইন এবং তথ্য শেয়ার করার সুযোগ করে দেয় ফেসবুক।
২০১৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক আলেক্সান্ডার কোগান, একটা কুইজ অ্যাপ তৈরি করেন। প্রায় ৩ লাখ মানুষ অ্যাপসটি ব্যবহার করে এবং তাদের তথ্যও শেয়ার করে। ওই সময়ের বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য পাওয়ার সুযোগ ছিলো কোগানের।
২০১৪ সালে ফেসবুকের কাঠামো বড় ধরণের পরিবর্তন আনা হয়। সীমিত করা হয় অ্যাপসগুলোর তথ্য আদায়ের সুযোগ। কোগানের অ্যাপসের মতো কেউ আর চাইলে ফেসবুক ব্যবহারকারীর বিস্তারিত তথ্য পাবে না।
২০১৫ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের মারফত আমরা জানতে পারি, আলেক্সান্ডার কোগান তার সংগ্রহ করা ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে দিয়েছে। নীতিবিরুদ্ধ হওয়ায় তাৎক্ষণিক কোগানের অ্যাপসকে নিষিদ্ধি করা হয়। সেই সাথে কোগান ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে বলা হয়, অবৈধভাবে সংগ্রহ করা সব তথ্য মুছে ফেলার জন্য। তারা সম্মত হয়।
গত সপ্তাহে আমরা জানতে পারি যে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা সম্ভবত সেসব তথ্য মুছে ফেলেনি। আমরা তাৎক্ষনিক ফেসবুকের সমস্ত ফিচার থেকে তাদের নিষিদ্ধ করি। সংস্থাটির দাবি, তারা সব মুছে ফেলেছে এবং তা প্রমাণে আমাদের ঠিক করে দেয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নীরিক্ষণেও রাজি হয়েছে।
কোগান, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা আর ফেসবুক। এই তিন পক্ষের মধ্যে আস্থাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। তার চেয়েও বড় বিষয়, ফেসবুক ও এর ব্যবহারকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আস্থার সংকট। আমাদের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে।
প্রথমত: ২০১৪ সালে কড়াকড়ি আরোপের আগেই যত অ্যাপস বিপুল পরিমাণ তথ্যে প্রবেশাধিকার পেয়েছে, তাদেরকে আমরা খতিয়ে দেখবো। তাদের কার্যক্রম সন্দেহজনক কিনা তা যাচাই করতে পুর্ণাঙ্গ নীরিক্ষণ চালানো হবে। কেউ যদি তাতে সম্মত না হয়, তবে তাকে নিষিদ্ধ করা হবে, এবং বিষয়টি ওইসব ব্যবহারকারীদের জানিয়ে দেয়া হবে, যারা সংশ্লিষ্ট অ্যাপসটিতে তথ্য শেয়ার করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত: আমরা ডেভেলপারদের ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্যে প্রবেশাধিকার আরও সীমিত করে ফেলবো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি কোন অ্যাপ ৩ মাসের মধ্যে ব্যবহার না করে থাকেন, তবে ওই অ্যাপের কাছে আপনার কোন তথ্য থাকবে না। অ্যাপসগুলো এখন আর সব রকমের তথ্য পাবে না। যদি আপনি নতুন কোন অ্যাপে সাইন ইন করেন, তবে সে শুধু আপনার নাম, প্রোফাইল পিকচার আর ইমেইল অ্যড্রেসটাই পাবে, আর কিছু নয়। এছাড়া আরও বেশ কিছু পরিবর্তনের চিন্তা বিবেচনায় আছে, যা কয়েকদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেয়া হবে।
তৃতীয়ত: আপনি কোন কোন অ্যাপসকে আপনার তথ্য শেয়ার করেছেন, সেটা আপনার জানা থাকা উচিত। আমরা বিষয়টা নিশ্চিত করতে চাই। আগামী মাসেই আমরা নিউজ ফিডে একটা টুল যোগ করব, যার মাধ্যমে আপনি সহজে দেখতে পারবেন সেসব অ্যাপসের তালিকা এবং চাইলে এক ক্লিকেই তাদের কাছ থেকে তথ্য কেড়ে নিতে পারবেন। এই ফিচারটা অবশ্য এখনও আছে, প্রাইভেসি সেটিংসে। কিন্তু সেটাকে আমরা নিউজ ফিডে তুলে আনতে চাই, যাতে সহজেই সবার চোখে পড়ে।
ফেসবুক আমরা হাতে গড়া। দিনশেষে এখানে যা ঘটবে, তার জন্য আমিই দায়ী থাকবো। বিশাল এই কমিউনিটিকে রক্ষার ব্যাপারে আমি দৃঢ়সংকল্প। যা ঘটে গেছে, তা আর বদলে ফেলা যায় না। কিন্তু আমি নিশ্চিত করছি, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো কাণ্ড সামনে আর কখনই ঘটবে। এটা আমাদের জন্য একটা বড় অভিজ্ঞতা, যেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এই প্লাটফরমকে আরো সুরক্ষিত করবো, যাতে আমাদের কমিউনিটির সবাই নিরাপদ বোধ করে।
আমাদের লক্ষ্যে যারা আস্থাশীল এবং ফেসবুক কমিউনিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমি জানি, উদ্ভুত সমস্যাগুলো সমাধানে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সময় লাগবে। কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবোই।”
Leave a reply