পুরনো জারাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে গ্যাস লিকেজ, কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও খামখেয়ালীপনা এবং গ্রাহকদের সচেতনতার অভাবেই একের পর এক গ্যাসের লিকেজের বিস্ফোরণে প্রাণ ঝরছে। দুই বছরে মারা গিয়েছে অর্ধশত, দগ্ধ হয়েছে দুই শতাধিক মানুষ।
নারায়ণগঞ্জে বিশেষ করে ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে গ্যাস বোমা নিয়ে জীবন যাপন করছে মানুষ। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার ভিতরে সময় কাটছে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসকারীদের।
ফায়ার সার্ভিসের হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে ১০৬ টি। তার মধ্যে ৮৬টি ঘটেছে পাইপ লাইনের গ্যাসের সংযোগ থেকে। দগ্ধ হয়েছে ৮২ জন। মারা গিয়েছে ৩৯ জন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাস বিস্ফোরণে ৩৭ জনের মৃত্যু। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ১২৫টি। তার মধ্যে গ্যাসলাইনে সংযোগ থেকে ঘটেছে ৮০টি। তার মধ্যে আগুনে দগ্ধ হয়েছে প্রায় ৯০ জন। মারা গিয়েছে প্রায় ২৫ জনের বেশী। সর্বশেষ ফতুল্লার লালখা এলাকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ ও দেয়াল চাপা পড়ে মারা যায় তিনজন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, বিকট শব্দে প্রতিটি বিস্ফোরণে লন্ডভন্ড হয়ে বাড়ির দেয়ালসহ ছাদ ধ্বসে পড়ে। ২০ থেকে ৩০ ফুট দূরে ছিটকে পড়ছে দেয়ালসহ দরজা জানালা ও ইটপাটকেল। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বহুতল ভবনসহ আশেপাশের বাড়িঘর ও দোকান। তবে বেশীরভাগ ঘটনাই ঘটে ভোর বা সকালে। এ নিয়েও মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতংক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর গ্যাসের বিস্ফোরণে বহু মানুষের প্রাণ ঝরলেও নির্বিকার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। প্রতিটি ঘটনায় গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখলেও জারাজীর্ণ গ্যাস লাইন সংস্কার বা মেরামত করা হয় না। তিন যুগের বেশী পুরনো জারাজীর্ণ লাইন দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে বাড়িঘরে গ্যাস সংযোগ।
ফতুল্লা শিল্পঞ্চলে বৃষ্টি হলেই দেখামিলে রাস্তায়, ড্রেনে জমে থাকা পানির ভেতর থেকে বুদবুদ করে গ্যাস বের হচ্ছে। আবার অনেক রাইজার দিয়ে শব্দ করে গ্যাস বের হয়। ম্যাচের কাঠি, বা সিগারেটের আগুন থেকে লেগে যাচ্ছে আগুন। ঘটছে দুর্ঘটনা।
২০১৫ সালে এমনই এক আগুনে ফতুল্লার লালখা মোড়ে একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়ে মারা যায়।
উত্তরসুরী না থাকায় বাড়ির নীচেই তাদের কবর দিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় ওই জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে মাদরাসা।
তিতাস গ্যাসের ম্যানেজার প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম তিতাস গ্যাসের জরাজীর্ণ সরবরাহ লাইনের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তার দাবি গ্রাহকের অসচেতনতার কারণেই ঘটছে বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারি পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, বড় বড় দুর্ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, অসাবধানতাবশত গ্যাসের চুলার বার্ণার চালু রেখে ঘুমিয়ে পড়া বা কোনো কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে বদ্ধঘরে জমাট বেধে থাকা গ্যাসে আগুনের স্পার্ক পেলেই ভয়াবহ বিম্ফোরণ ঘটছে। তাই গ্যাসের গ্রাহকদের আরও বেশী সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তার দাবি গ্যাসের চুলায় আগুন দেয়ার আগে দরজা জানালা খুলে যেন আগুন ধরানো হয়।
তিতাস গ্যাসের জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইন পরিবর্তন করার জন্য ইতিমধ্যে তিতাসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন লাইন থেকে চোরাই পথে সংযোগ নেয়া, গ্রাহকদের সচেতনতার অভাবেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, বিস্ফোরণে প্রাণহানি কমাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণে জরাজীর্ণ সঞ্চলন লাইন বা রাইজার ও চুলার লিকেজের বিষয়টি দ্রুত যেন সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানানোর তাগিদ দেন তিনি।
Leave a reply