করিম উদ্দিন ভরসার ইন্তেকাল, সম্পত্তির জন্য চিকিৎসা না করার অভিযোগ দুই ছেলের বিরুদ্ধে

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও শিল্পপতি করিম উদ্দিন ভরসা (৮৭) ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সম্পত্তি দখল বিরোধের জেরে ‘হেবিয়াস করপাস’ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও তার ১২ পুত্র-কন্যাকে মৃত্যুশয্যায় করিম উদ্দিনকে দেখতে দেননি তার অপর দুই পুত্র সিরাজুল ইসলাম ও শিমুল ভরসা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার ১২ ছেলে মেয়ে। তাদের অভিযোগ, ওই দুই পুত্রের কাছে বন্দি অবস্থায় থাকায় তার সুচিকিৎসা হয়নি। করোনা আক্রান্ত থাকলেও বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি তারা, বরং নিজেদের কাছে আটকে রেখে তার সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন করিম উদ্দিন ভরসার ওই দুই পুত্র।

সাবেক এমপি করমি উদ্দিন ভরসার সপ্তম পুত্র কামরুল ইসলাম ভরসা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শনিবার (২৩ জুলাই) দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে মারা যান আমার বাবা। তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন। আমার দুই ভাই সিরাজুল ইসলাম ভরসা এবং সাইফুল উদ্দিন শিমুল ভরসার কাছে বন্দি থাকা অবস্থাতেই বাবাকে করোনা আক্রান্ত হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্ত কোনো ভালো ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও আমাদের ১২ ভাইবোনকে বাবার মৃত্যুশয্যায় দেখা করতে দেয়নি। ফলে আমরা আমাদের গর্বিত বাবার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা বাইরে থেকে ওই দুই ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম বাবাকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু তারা তা করেনি।

তিনি অভিযোগ করেন, শুধু বাবার সম্পদ আত্মসাতের জন্যই আমার ভাই সিরাজুল এবং শিমুল ভরসা বাবাকে এভাবে বন্দি করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে মেরে ফেলেছে। এই উপমহাদেশে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে আওরঙ্গজেব তার পিতাকে কৌশলে বন্দি করে রেখেছিলেন সিংহাসনের জন্য। এরপর আমাদের পরিবারে এই ঘটনা ঘটলো, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বাবার উন্নত চিকিৎসা না করে দুই ভাই তাকে মেরে ফেললো। শুধু সম্পত্তি আত্মসাতের লোভে এই ঘটনাও ইতিহাস হয়ে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করে সিরাজুল ইসলাম এবং সাইফুল উদ্দিন শিমুল ভরসা বলেছেন, আমার বাবার কোনো চিকিৎসার অবহেলা করা হয়নি। সর্বোচ্চ উন্নত চিকিৎসা করা হয়েছে। সম্পত্তি অবৈধ ভাবে লিখে নেয়ার জন্য বাবাকে বন্দি করে রাখার অভিযোগ সত্যি নয়। আদালতের আদেশেই বাবা আমাদের কাছে ছিল।

সাবেক এমপি করিম উদ্দিন ভরসার দ্বিতীয় পুত্র এবং এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভরসা জানান, আমার বাবার দুই স্ত্রীর ঘরে আমরা ১৬ সন্তান। ভাইবোনদের মধ্যে সাইদুল ইসলাম ভরসা এবং কাজল ভরসা মারা গেছেন। আর ফখরুল ইসলাম ভরসা ও সোহেল ভরসা থাকেন দেশের বাইরে। আমাদের প্রথম মা ছকিনা করিম মারা গেছেন। অপর মা সুলতানা রাজিয়া (৭৫) এখনও বেঁচে আছেন। ১৯৮৮ সালে রহিম উদ্দিন ভরসা এবং করিম উদ্দিন ভরসার মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগির পর আমার বাবা ও ভাইয়েরা ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। আমার বাবার নামে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। আমাদের ভরসা পরিবারের সুনাম ছিল দেশময়। আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে হাজার হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল। শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাই সিরাজুল ইসলাম ভরসা ২০০৫ সালে আমার বাবার কাছে আলাদা কোম্পানি করে চাইলে আবার বাবা তা অস্বীকার করেন। এর পর থেকেই তিনি শিমুল ভরসাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন।

করিম উদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিড়ি সিগারেট, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, কাগজ মিল, কোল্ড স্টোরেজ, হাউজিং, ইমপেক্স, আরকে ফ্যানসহ বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা গড়েছিলেন তিনি। সেখানে একসময় প্রায় ৩০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী কাজ করতেন। সংসদে দাঁড়িয়ে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ‘হামার সরু সড়ক চ্যাপ্টা করি দাও বাহে স্পিকার’ বক্তব্য দিয়ে দেশে বিদেশে আলোচিত ছিলেন তিনি। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার মৃত্যুতের শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো রংপুরে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, রংপুর-৩ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব সাদ এরশাদসহ রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব, প্রেসক্লাব, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী-শ্রমজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং মরহুমের প্রতিষ্ঠিত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী-শ্রমিকবৃন্দ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়েছে।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply