দুর্নীতির দুই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আদালতে পৌঁছান বিএনপি চেয়ারপারসন। ১২টা ১২ মিনিটে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য শুরু করেন খালেদা।
তিনি বলেন, জিয়া অর্ফানেজ মামলা, এর কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধান ও আইনকানুনের মধ্যে সীমিত নয়। পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা না করে শুধু আইনগত দিক বিবেচনা করলে আমার বক্তব্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। মাননীয় আদালত, অনুরোধ করছি আমার কথা শুনবেন। সময় দেবেন। যাতে পুরো পটভূমি পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে পারি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গ টেনে খালেদা জিয়া তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, গত নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যায়নি, তাই এই সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকার বৈধ হতে পারে না। দেশে বর্তমানে এক গভীর সাংবিধানিক সংকট তৈরি করা হয়েছে।
নিজের রাজনীতিতে আগমন উপলক্ষ্যে বলেন, “তিন যুগ আগে রাজনীতি শুরু করেছি। নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন ছেড়ে অনিশ্চিত পথে পা দিয়েছিলাম। সেসময় ক্ষমতার মসনদ ছিলো না। অবৈধ ক্ষমতাশালীদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে তিন যুগ ধরে রাজনীতি করে যাচ্ছি। আমি রাজপথের রাজনীতিক। জিয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম। তাঁর অসামাপ্ত লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। সব সময় চাই বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিকভাবে চলে, দেশের মানুষের ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা থাকে। বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে তোলার জন্যই আমার রাজনীতি।
খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের চাওয়াই আমার চাওয়া। আমার জীবন পুরোপুরি জনগনের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। দেশ ও জাতি যখন দুর্যোগে পড়েছে, তখন আমিও দুর্যোগে পড়েছি, আমার পরিবারও সংকটে পড়েছে।
‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্য মামলা দায়ের অব্যাহত আছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে। চার দশকের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাসা ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরোধ করে রাখা হয়েছে। অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় পরিষেবা লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেই অবরুদ্ধ অবস্থায়ই আমি আমার ছোট সন্তানের মৃত্যু সংবাদ পাই,’ বলেন খালেদা। সন্তানের মৃত্যুর কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘সেই অবস্থাতেও আমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলো কি সভ্য-মানবিক আচরণ, মাননীয় আদালত?’
তিনি বলেন, শাসক মহলের নির্দেশে আমার স্বাধীনভাবে চলাচল ব্যাহত করা হয়েছে। প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আমার ওপর বারবার হামলা বিশ্ববাসী দেখেছে। আমার গাড়িবহরে সশস্ত্র হামলা হয়েছে। গাড়িতে গুলি চালানো হয়েছে। কোন ঘটনার বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। আমার নাগরিক অধিকার ব্যহত করা হয়েছে বারবার। অসত্য ও কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও দুর্দশার সাথে আমাকে হেনস্তা করার বিষয়টি জড়িত।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘মাননীয় আদালত আমি যত সামান্য মানুষই হইনা কেন, বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ ও পটভূমির ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়।
দেশে কোন নির্বাচিত সংসদ ও সরকার নেই মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সংসদের বেশিরভাগ প্রতিনিধি নির্বাচিত নন। বাকীদের ভোটাররা নির্বাচিত করেনি। তারা প্রহসনের মাধ্যমে এসেছেন। নির্বাচনের দিন শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এই সংসদের মাধ্যেমে গঠিত সরকার বৈধ হতে পারে না। সংসদে কোন কার্যকর বিরোধী দল নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধংস করা হয়েছে। সিটি করপোশনের নির্বাচনগুলোতে কারচুপি সত্ত্বেও বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। এতে ভীতু হয়ে ক্ষমতাসীনরা পরবর্তী স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মামলা দিয়ে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, একদলীয় শাসন তৈরির মাধ্যমে দেশে গভীর সাংবিধানিক সংকট তৈরি করা হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
খালেদা জিয়া প্রশ্ন করেন, ‘সংঘাতের বদলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, এটাই কি আমার অপরাধ? সে কারণেই কি আমার বিরুদ্ধে এত মামলা আর হেনস্তা?’
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও নানা রকম মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর পরম সৌভাগ্য কখনো তাকে আমার মতো আদালতে হাজিরা দিতে হয়নি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই এই বয়সে বহু সমস্যার মধ্যেও আদালতে নিজে হাজির থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার আইনজীবীরা আইন মোতাবেক মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি কখনো অনিবার্য কারণে আদালতে আসতে না পারলে গ্রফতারি পরোয়ানা জারি করার মত ঘটনা ঘটেছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমার পরিচয় দেশবাসী জানে। আদালতও জানেন। আমি জিয়াউর রহমানের পত্নী। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। রণাঙ্গনের সফল অধিনায়ক। তিনি বিরোত্তম। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সাবেক সেনা প্রধান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক। জননির্বাচিত ও সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তিনি।’
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আমি সবচেয়ে বেশি নির্বাচিত হয়েছি। গত ৯ বছরে স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছি। উন্নয়নে- উৎপাদনে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, সন্ত্রাস দমন ও মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছি।’
এ পর্যন্ত বলে খালেদা জিয়ার আজকের মতো তার বক্তব্য শেষ করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ আগামী ২ নভেম্বর ধার্য করেন আদালত।
খালেদার বক্তব্যের বিষয়ে দুদকের আইনজীবী আদালতে বলেন, তিনি মামলার প্রেক্ষাপটে বক্তব্য না দিয়ে অহেতুক প্রসঙ্গে বক্তব্য দিয়েছেন।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।
কিউএস
Leave a reply