গাইবান্ধা প্রতিনিধি :
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের কান্তনগর বিনয় ভূষণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক রেজা শাহজাহান প্রামাণিককে মারধর ও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনার প্রতিবাদে প্রধান শিক্ষক একরামুল হক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি রওশন আলম মণ্ডলকে ৫ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা।
এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের লাঞ্চিত করে অফিস কক্ষ ও লাইব্রেরীর দরজা-জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অবরুদ্ধের এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ উভয় পক্ষকে নিয়ে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা আলোচনার পর প্রশাসনের বিচারের আশ্বাসে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অবরুদ্ধ থেকে রক্ষা পায় প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি।
এরআগে, বুধবার (২৮ আগস্ট) বিকেল ৩টার দিকে বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ করাকে কেন্দ্র করে সহকারী শিক্ষক রেজা শাহজাহান প্রামাণিকে বেদম মারধর করেন প্রধান শিক্ষক একরামুল হক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি রওশন আলম মণ্ডল। এসময় ‘তোর কোন বাপ আছে’ এমন কথা বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি।
শিক্ষক শাহজাহান প্রামাণিকের অভিযোগ, হঠাৎ করে প্রধান শিক্ষক তাকে ডেকে তার কক্ষে নেয়। এসময় প্রধান শিক্ষক তাকে স্কুলের দাপ্তরিক কাজ করতে চাপ দেয়। কিন্তু তাতে রাজি না হলে তর্কে জড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন প্রধান শিক্ষক। এক পর্যায়ে তিনি গালে থাপ্পর ও পরে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। পরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে কক্ষ থেকে বের করার পর সভাপতি রওশন আলম মণ্ডল এসেও শার্টের কলার ধরেন। এরপর প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি তাকে বেদমভাবে কিল-ঘুষি মেরে গুরুত্বর আহত করেন। ঘটনা দেখে অন্য শিক্ষকরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে।
এদিকে, প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি শিক্ষক রেজা শাহজাহানকে মারধর ও লাঞ্চিতদের ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ স্থানীয় এলাকাবাসী। ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার দাবীতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিদ্যালয় চত্তরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা। এসময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবক ও স্থানীয় এলাকাবাসীও অংশ নেয়।
পরে সাড়ে ১০টার দিকে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি বিদ্যালয়ে আসলে ক্ষোভের মুখে পড়েন এবং লাঞ্চিত হন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দরজা-জানালা বন্ধ করে অফিস কক্ষে আশ্রয় নেয় প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। এক পর্যায়ে অফিস কক্ষে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা। এসময় তাদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবিতে অফিস কক্ষ ঘেরাও করে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি অবরুদ্ধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেস্টা করলে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে বাধ্য হয়ে ইউএনওকে খবর দেয় পুলিশ।
উপজেলা চেয়ারম্যান শাহারিয়া খান বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে ইউএনও নবীনেওয়াজ। পরে পুলিশি নিরাপত্তায় অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক-সভাপতি, হামলার শিকার শিক্ষক ও অভিভাবকসহ স্থানীয়দের নিয়ে আলোচনায় বসেন ইউএনও। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর ঘটনার জন্য প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি ভুল স্বীকার, এক মাসের মধ্যে পরিচালনা কমিটি গঠনের সিন্ধান্ত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুর্বণা রাণী মোদক ও রুহুল আমিন সরকার বলেন, প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি প্রায়ই শিক্ষক-কর্মচারীদের মারধর ও লাঞ্চিত করে আসছেন। এরআগে অফিস সহকারী আবদুস ছালামকে মারধর করে বরখাস্ত করা হয়। আবদুস ছালাম বরখাস্ত হওয়ায় বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ করতে শিক্ষকদের চাপ দেয় প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। এছাড়া বিভিন্ন সময় নানা কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে অসদচারণ করেন তারা। শুধু তাই নয়, কিছুদিন ধরে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান শিক্ষিকার সঙ্গে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন সভাপতি। এরপর থেকে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। এসব ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তসহ তাদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবি জানান তারা।
বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য আসাদুজ্জামান তুহিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পরোক্ষ যোগসাজসে বিদ্যালয়ের আর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে আসছেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরদ্ধে আদালতে মামলা করেন তিনি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেলহাজতও খেটেছেন তারা। এছাড়া অফিস সহকারী আবদুস ছালামকে মারধরের ঘটনায় আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব ঘটনার পরেও দাপট কমেনি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির’।
স্থানীয় আ’লীগ নেতা রানা মণ্ডল বলেন, ‘একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি ও শিক্ষক-কর্মচারীদের মারধরের ঘটনার পরেও বহাল তবিয়তে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও আবারও প্রধান শিক্ষক গোপনে এডহক কমিটিতে রওশন আলমকে আহ্বায়ক করেন। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান শিক্ষক ফারজিনা জান্নাতুলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সভাপতি।
এরআগে, ২৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ নির্বাচনে বোরকা পড়ে জাল ভোট দেয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হন রওশন আলম মণ্ডল, পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেয় বিচারক। রওশন আলম স্থানীয় হওয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রভাবে এসব অপকর্ম করে আসছেন। কিন্তু এসবের বিচার না হওয়ায় তাদের দাপট যেমন বাড়ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।
এ বিষয়ে সাদুল্যাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নবীনেওয়াজ বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে আপোষ করা হয়েছে। শিক্ষক শাহজাহানকে লাঞ্চিতের ঘটনায় ভুল স্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। এছাড়া পরিচালনা কমিটি গঠনের লক্ষ্যে প্রাধান শিক্ষককে একমাস সময় দেয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি গঠন করা হবে।
এদিকে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি রওশন আলম মণ্ডল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কঠোর ও শিক্ষার মান উন্নয়নে চাপ দেয়ায় কিছু শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। এ কারণে শিক্ষক শাহজাহানের সঙ্গে বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটে। তবে মারধর ও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার অভিযোগ সত্য নয়।
Leave a reply