বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে নির্যাতন করা আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিম উদ্দিনের সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি এরকম ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
জানা যায়, সাংবাদিক নির্যাতনকারী নাজিম উদ্দিন গত ২০১৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) হিসাবে যোগদান করেন। এসময় তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্থানীয় এক বৃদ্ধকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এ ঘটনায় তাকে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝিকে (৬২) কানে ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
সে সময়ে এক সংবাদমাধ্যমকে নফু মাঝি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘটনার দিন হঠাৎ করেই সেখানে কয়েকজন লোক গিয়ে জমি পরিমাপ করা শুরু করেন। এ সময় আপনারা কারা জিজ্ঞেস করতেই এসিল্যান্ড নাজিম আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমাকে মারধর করে মাটিতে ফেলে দেন। পরে তাকে সেখান থেকে তুলে কান ও শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে গাড়িতে তুলে এসিল্যান্ড সদরের অফিসে নিয়ে যান।
তিনি দুঃখ নিয়ে বলেন, ঘটনার সময়টি পবিত্র রমজান মাস ছিল। আমি রোজা রেখেছিলাম। জানি না এমন কী অপরাধ করেছিলাম, তিনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করলেন। আমি জানি, আল্লাহই সঠিক সময়ে এসবের সঠিক বিচার করবেন।
বর্তমানে নাজিম উদ্দিন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার (রাজস্ব শাখা, এলএ শাখা, ব্যবসা ও বানিজ্য শাখা এবং আরএম শাখা) কর্মরত।
নাজিম উদ্দিন বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম বলেন, আরিফুল জানান, শুক্রবার রাত ১২টায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়ার সময় হঠাৎ করেই দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পান আরিফুল। তখন পরিচয় জানতে চাইলে ওপাশ থেকে বলা হয় ’থানা থেকে আসছি’। এসময় আরিফুল সদর থানাও ওসিকে ফোন দিলে ওসি থানা থেকে তার বাসায় কাউকে পাঠানো হয়নি বলে জানায়।
ফোন দেয়ার কথা শুনে দরজার বাহিরে থাকা আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার, রাজস্ব) নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল লোক দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে।
আরিফুল বলেন, মধ্যরাতে আমার বাড়ির দরজা ভেঙে আমার ওপর প্রথম আঘাত করেন আরডিসি। উনি আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন, এরপর আমাকে টেনে-হিচঁড়ে নিয়ে আসেন। মাইক্রোতে নেয়ার সময় আমাকে হাত এবং চোখ বেঁধে ফেলেন। এবং এনকাউন্টার দেয়া হবে বলে আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টার দিতে চান। আমি অনেক আকুতি-মিনতি করি, আমার সন্তানদের কথা বলে প্রাণভিক্ষা চাই, এরপরও তারা ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না; আমাকে বারবার বলছিলেন কলেমা পড়ে নে, কলেমা পড়ে নে। আরডিসি আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন। এরপর কোনো এক অজ্ঞাত জায়গা থেকে ঘুরিয়ে আমাকে আবার ডিসি অফিসের মোড়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
সেখানে সুযোগ পেয়ে চোখের বাধন আলগা করেন জানিয়ে আরিফুল বলেন, বুঝতে পেরেছি যে এটা ডিসি অফিস। এরপর আমাকে একটা রুমে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও নির্যাতন করা হয়। আরডিসি নিজেই আমাকে মারধর করেছেন। আমাকে বিবস্ত্র করে আমার ভিডিও ধারণ করা হয়। আমার কাছ থেকে ৪টি স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে চোখ বাঁধা অবস্থায়। সে কী জন্য আমি জানি না। এরপর তাড়াহুড়ো করে আমাকে কারাগারে রেখে আসেন।
জামিন আবেদনের বিষয়ে কিছু জানেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে আসার আগে আমার সাথে যা কিছু হয়ে সব আমার অমতে হয়েছে, জোরপূর্বক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মাদকবিরোধী অভিযানে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে ৪৫০ গ্রাম দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি টাস্কফোর্সের। তবে এ ঘটনার পর আরিফুলের স্ত্রী দাবি করেন, পুরো ঘটনাই সাজানো। দরজা ভেঙে আরিফুলকে মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে চ্যাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে, আরিফুলের জামিন হয়েছে। জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ডিসিসহ প্রশাসনের ৪ কর্মকর্তার গাফলতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
Leave a reply