মাহফুজ মিশু:
বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ১০০ বছর! আর স্বাধীন বাংলাদেশ ৫০ বছরের। যে দেশটির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং স্বাধীন করে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন, সেই বাংলাদেশ ৪ বছরও পায়নি তার জাতির পিতাকে। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝে শুনে সে সময়ের চৌকস কিন্তু ভীষণ লোভী কিছু সেনা কর্মকর্তা, তাদের দেশি বিদেশি রাজনৈতিক দোসররা এক হয়ে কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, তাঁর সাথে থাকা পরিবারের সবাই এবং স্বজনদের হত্যা করে। সে সব খুনিদের দায়মুক্তি দেয়ার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে খুনীদের ‘বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা’ হিসেবে আদর আর পুনর্বাসন করে গেছে পরবর্তী কয়েকটি সরকার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা কিংবা অপরিহার্যতা বুঝতে গেলে, তাকে কেন হত্যা করেছিল ঘাতকরা সেটি বোঝা সবচে জরুরি।
বঙ্গবন্ধুর পা থেকে মাথা জুড়ে ছিল কেবলই বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের শাসনভার গ্রহণ করে সংবিধান প্রণয়ন, সামরিক বেসামরিক প্রশাসন পুনর্গঠন, অবকাঠামো-রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয় নিশ্চিত করা, হাজারো কাজ তখন বঙ্গবন্ধুর। এত ব্যস্ততার মধ্যেও দূরদর্শী শেখ মুজিব টের পেয়েছিলেন, তার প্রশাসন-আমলাদের কেউ কেউ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। জাতির পিতা সে কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণও করেছিলেন বিভিন্ন বক্তৃতায়। বলেছিলেন, বিদেশ থেকে আনা সাহায্য কারা কীভাবে লুটপাট করছে! বঙ্গবন্ধু জানতেন, তার কৃষক-শ্রমিক, গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষ দুর্নীতি করে না। এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন হয় ঐ গরীবের পরিশ্রমের টাকায়! এই সুবিধাভোগী, ঘুষখোর আমলাদের কাছে তাই মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বিশাল আতঙ্কের নাম।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসীম সাহসী, প্রবল ছিল তার ব্যক্তিত্ব। তার সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার আগে ব্রিটেনের তৎকালীন সরকার প্রধানের সাথে শেখ মুজিবের সাক্ষাতের ছবিটির দিকে তাকায়েন! বুকটান করে শিরদাঁড়া সোজা এক মহামানবের ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাসের কাছে বিলীন হয়ে গেছে পরাক্রমশালী সেই রাষ্ট্রপ্রধানের অবয়ব। সেদিনই তো বিশ্ব নেতৃত্ব ধারণা পেয়েছিলেন, স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক মুজিব কারো তাবেদার হবেন না। তারপর দেশে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের তাদের নিজ দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করেন মুজিব। তারপর জাতিসংঘে তাঁর তেজোদীপ্ত ভাষণ, বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত, শাসক আর শোসিত। এখানেই থামেননি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। চিনিয়েছেন নিজেকে, ‘আমি শোসিতের পক্ষে’। পরাজিত পাকিস্তান আর তার সে সময়ের মিত্র দেশগুলো সেদিনই টের পেয়েছিলেন, অন্য ধাতু দিয়ে গড়া এই বাঙালি নেতা। কাজেই বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেতে শুরু করে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও।
ঘরে-বাইরে, প্রশাসনে-রাজনীতিতে-কূটনীতিতে ক্ষমতালিপ্সু, দুর্নীতিপরায়ণ আর আধিপত্যবাদীদের শত্রুতে পরিণত হলেন মানবতাবাদী নেতা মুজিব। তাদের সেই সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। কেবল বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবার-স্বজন নয়, হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশকে, মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে, বিশ্ব মানবতার অন্যতম কান্ডারিকে।
এখানেই বঙ্গবন্ধুর অপরিহার্যতা এবং প্রাসঙ্গিকতা এখনো। এখনো বাংলাদেশ বা সমকালীন বিশ্বের প্রায় সব সংকটের সমাধান খুঁজতে দারুণ প্রাসঙ্গিক শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা কিংবা আমার দেখা নয়াচীন পড়লে স্পষ্ট হবে মুজিবের দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও মানবপ্রেম। যেমন, ১৯৫২ সালে চীন সফরে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা আমার দেখা নয়াচীন। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিদেশে গেলেও দেশের মানে তৎকালীন পাকিস্তান সম্পর্কে বিদেশিদের কাছে নেতিবাচক কোনো কথা বলতে চাননি বঙ্গবন্ধু। এমনকি সেই প্রতিনিধি দলের সিদ্ধান্তই ছিল সেটি না করার। একবার ভাবুন, এই সময়ের কথা। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার সবকিছুর সমাধানে অনেকটা যেচে পড়ে বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ দেই আমরা, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো!
আবার চীন যাওয়ার পথে সে সময়ের বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের বাসায় বাসভবনে গিয়েছিলেন তরুণ নেতা মুজিব। সেখানে কূটনীতিকের জীবনযাপনের বিলাসিতা তাকে ব্যথিত করেছিল ভীষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাবনা তো এখনো প্রাসঙ্গিক। কেবল কূটনীতিক কেন, সামরিক বেসামরিক আমলা, ডিসি-এসপি সবার ক্ষেত্রেই।
শেষ করি, বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলে। সে সময় এক মধ্যরাতে আদেশ এলো, তাকে ঢাকা থেকে অন্য কারাগারে নিতে হবে। জেল কর্তৃপক্ষ, মধ্যরাতে মুজিবকে বের করার উদ্যোগ নিল। সেজন্য জেলের ছোট গেট খোলা হলো। তাতে করে বঙ্গবন্ধুকে মাথা নিচু করে বের হতে হয়। মুজিবের স্পষ্ট অবস্থান, তিনি মাথা নিচু করেন না, করবেনও না। অবশেষে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে বড় গেট খুলতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এটাই মুজিব! আমাদের আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদার প্রতীক।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।
Leave a reply