অফ মেন অ্যান্ড ভেনজেন্স

|

অলংকরণ: তানভীর ফারুক।

মার্কিন লেখক ডোনাল্ড মার্টিন হনিগের গল্প ‘অফ মেন অ্যান্ড ভেনজেন্স’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, কিংবদন্তি পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার আলফ্রেড হিচকক সম্পাদিত ডেথ ক্যান বি বিউটিফুল সংকলন গ্রন্থে। ইংরেজি থেকে রূপান্তর করেছেন তানভীর মৌসুম।

একজন মানুষ সব কিছু ভুলতে পারে, তবে যার কথা এখানে আলোচনা হচ্ছে সে একটা ব্যাপার কিছুতেই ভুলতে পারছে না। হয়তো কোনওদিন পারবেও না। ওই একটা ঘটনা ওর স্মৃতির চিলেকোঠায় এখনও সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট, অকস্মাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো প্রায়ই ঘটনাটা মনে পড়ে। ডেভিডের বয়স এখন পঁচিশ, গত এগারো বছর ধরে স্মৃতিটা ওকে নিষ্ঠুরভাবে খুঁচিয়ে চলছে।

সেই স্মৃতি এখনও জাজ্বল্যমান, কারণ ওদিনের ঘটনায় বেচারা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিল। আঘাতের বিরতিহীন জোয়ার-ভাটা জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে। হতাশা গেঁড়ে বসেছে মনের ভিতর, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফুঁসছে ক্রমাগত।

চৌদ্দ বছর বয়সেই প্রেমে পড়ে ও, মেয়েটা ছিল এস্টেল। অসাধারণ এক সুন্দরী। ডেভিড চায়নি এস্টেলের প্রতি ওর দুর্বলতা প্রকাশ পাক। তাই সে মেয়েটার সাথে গোপনে দেখা করার ফন্দি আঁটে। তারপর ওদের দেখা হতে লাগল মেয়েটার বাসার পিছনের উঠোনে। ওরা সেখানে বসে থাকতো। উঠোনে খেলাধুলা করতো নয়তো নাশপাতি গাছগুলোর উপর উঠে যেত। গাছ ছিল এস্টেলের লুকানোর প্রিয় জায়গা। উঠোনের পিছনে একটা বাঁধ, যেটায় বসে ওরা ফ্রেইট ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখত। এসব ডেভিড কখনও ভুলতে পারবে না।

মেঘে ঢাকা সেই অন্ধকার বিকেলে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে। বিকেলটার কথা মনে পড়লেই ওর ভিতর জেগে উঠে প্রতিশোধের স্ফুলিঙ্গ! সেদিনও যাচ্ছিল এস্টেলের সঙ্গে দেখা করতে, গন্তব্য সেই উঠোন। ওর মা-বাবা সেদিন বাসায় থাকবে না, এস্টেল ডেভিডকে বলেছিল। বৃষ্টি হলেও তাই সমস্যা নেই, তখন ভিতরে গিয়ে ফনোগ্রাফ বাজানো যাবে।

নিরেট অন্ধকারে তৈরি বিশাল মেঘপুঞ্জ সব পুরো ক্যাপস্টোনকে ভাসিয়ে দেয়ার ভয় দেখালেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না ডেভিড। নিজের বাসা থেকে রীতিমত ছুটে বেরিয়ে এল। দৌড়ে এস্টেলদের বাসার উঠোনের কাছে যেতেই দূরে কোথাও গর্জে উঠল মেঘ, ডেভিড তখন মেয়েটাকে ডাকছিল।

প্রেয়সীর আগে লোকটাকে দেখতে পায় ডেভিড। ঝোপঝাড় আর কাঁটা গাছের জড়ানো ডাল ঠেলে বাড়ির পিছনের দিকে চলে যাচ্ছিল, ফ্রেইট ট্র্যাকের উপরে। ডেভিড লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পায়, শ্যামবর্ণ মুখটা সে প্রায়ই এ পাড়ায় দেখে এসেছে।

ওকে দেখামাত্রই যেন ”কেলার” নামটা মস্তিষ্কের ভিতর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হলো! তখনই বজ্রবিদ্যুৎ সাদা রঙের চাবুক মেরে মেঘপুঞ্জ দু’ভাগ করে দেয়। তার পরপর সশব্দে বৃষ্টিপাত। লোকটা বাঁধের উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, এক অপস্রিয়মাণ অস্পষ্ট অবয়ব। ডেভিড চিৎকার করে উঠল,’থামুন!’

এরপরই ও দেখতে পায় এস্টেলকে। ঘাসের উপর শুয়ে আছে, মাথাটা ডেভিডের দিকেই ঘুরানো, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ওর নাম ধরে ডাকতে যাবে সেই সময় আবার বজ্রবিদ্যুৎ ঝিলিক মেরে উঠলো। বৃষ্টিতে মেয়েটার সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে অথচ সামান্য একটু ভ্রূক্ষেপও নেই।

নিচে শোনা গেল মৃদু গর্জন, একটা ফ্রেইট ট্রেইন চলে যাচ্ছে। শব্দের তীব্রতা কমে গেছে বজ্রপাতের জন্য।

উল্টো ঘুরে প্রচণ্ড জোরে দৌড়নো শুরু করে ও, আতঙ্কে বেচারার সারা গা কাঁপছিল। বলতে গেলে ঘরের দরজা বিদীর্ণ করে ভিতরে ঢোকে ও, বৃষ্টিতে কাকভেজা। চোখের পানি, বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার। ওর মা-বাবা তাই বুঝতে পারল না ছেলে কাঁদছে। নিজের রুমে ঢুকে বসে বসে কাঁপতে থাকে ডেভিড। একটু আগের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না খানিক আগে দেখা ঘটনাগুলো। টেলিফোনে পুলিশকে ফোন দিল। দুই হাতে রিসিভার কানের কাছে ধরা।

‘হ্যালো?’

‘হ্যালো… আমি কিছু বলতে চাই। এস্টেল স্যাম্পসন সম্পর্কে… আজ বিকেলে ওকে খুন করেছে এক লোক…’ নিজের কথা শুনে বেচারা নিজেই ভয়ে আধমরা হয়ে গেল।

এরপর এ ব্যাপারে আর কাউকে কিছু বলেনি।

পুলিশ ওদের বাসায় এলো কারণ ডেভিড ছিল মৃত মেয়েটার বন্ধু। ছেলেটা শুধু বলল সেদিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় ও বাইরে যায়নি। ফোন কলের ব্যাপারটাও অস্বীকার করল। পুলিশেরা সরল বিশ্বাসে মেনে নিল ডেভিডের কথা। এস্টেলের হত্যাকাণ্ড অমীমাংসিতই রয়ে গেল।

ওদের বাসার পিছনে থাকা ঝোপঝাড়ে ভাঙা কিছু ডাল পড়ে ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল অতি সম্প্রতি কেউ ওদিক দিয়ে গেছে। সেই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র ক্লু। আর বাসার ভিতরটা পুরো তছনছ, মূল্যবান সব জিনিস গায়েব! পুলিশ ধারণা করছে মেয়েটা হয়তো অনুপ্রবেশকারীকে পালিয়ে যাবার সময়ে চমকে দিয়েছিল, যার মূল্য দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে!

প্রচণ্ড শোকে ডেভিডের মনটা ভারভার হয়ে থাকলেও একটা জিনিস ওর নজর এড়াল না। কেলার, যাকে আগে সবখানে দেখা যেত, সে এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেছে।

এলাকায় সবার মাঝে তখন চাপা উত্তেজনা, সবার আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই- এস্টেল হত্যাকাণ্ড। তবে সময়ের সঙ্গে একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সেই উত্তেজনা। কিন্তু ডেভিডের মনের ভিতর তখনও সেটা নিষ্ঠুরভাবে স্পষ্ট! ও মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারল না সেদিনের ঘটনাটা। কালো এক চাদরের মতো সেই ভয়ংকর মুহূর্ত ওর ভাবনার মধ্যে থেকে গেল। নষ্ট হয়ে গেল রাতের ঘুম।

সময় গড়িয়ে চলল, ডেভিড থেকে গেল ক্যাপস্টোনে। হাইস্কুল শেষে শহরের এক ফ্যাক্টরিতে চাকরি নিল। মেশিনের কাজ, প্রথমে হেল্পার তারপর কাটার। কারণ কাজটায় বেশি ঝামেলা নেই, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা শুধু। বেশি কিছু চিন্তা করতে হয় না ফলে অতীত নিয়ে ভাববার অনেক সুযোগ পায়। একদম সোজা বাসায় চলে যায় কাজ শেষ হলে। জীবনটা একদম সাদামাটা কারণ হতাশা ওকে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরেছে।

কদাচিৎ মেয়েদের সঙ্গ দেয়, কেউই এস্টেলের সমকক্ষ না। নতুনভাবে কাউকে আর ভালোবাসা সম্ভব নয়, অনেক আগেই বুঝে গেছে সেটা। এস্টেলের স্মৃতি এখনও লালন করে ও, কারণ দু’জনের বাসা একদম কাছাকাছি। কারণ ওর মা-বাবার সঙ্গে প্রায়ই রাস্তায় দেখা হয় ওর। এভাবেই চলে দিনের পর দিন, ডেভিড মনে মনে শুধু একটাই শপথ করে, একবার যদি সুযোগ পেতাম, নগদ খুন করে ফেলতাম ব্যাটাকে!

এভাবেই হয়তো সারাজীবন চলে যেত ওর, কিন্তু একদিন দেখল এলাকাতে কেলারের আবির্ভাব ঘটেছে!

গ্র্যান্ট অ্যাভিনিউ দিয়ে হাঁটছিল, একটা রেস্টুরেন্ট অতিক্রম করার সময় জানালার দিকে চোখ গেল। দেখল সেই পাথুরে শ্যামবর্ণ চেহারা! যে চেহারাটা ও এখনও ভুলেনি, কোনওদিন ভুলবেও না! যে চেহারার অধিকারী ওর জীবনটা আজ থেকে এগারো বছর আগে তছনছ করে দিয়ে যায়! মূর্তির মতো জায়গায় জমে গেল ডেভিড, একদৃষ্টিতে কেলারের দিকে তাকিয়ে আছে! যদিও কেলার ওর দিকে পাল্টা দৃষ্টি হানছিল না। এ এক অসাধারণ অনুভূতি, এক নিমেষে ডেভিড যেন নবজীবন লাভ করল!

কিন্তু একসময় দু’জনের মধ্যে চোখাচোখি হলো। কেলারের মাথাটা উঁচু হলো একটু। ওর দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা ঝিলিক! তাড়াতাড়ি আবার হাঁটা শুরু করল ডেভিড, ভয় আর উত্তেজনায় সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি!

ও চেনে আমাকে! জানে আমিই সেই ছেলেটা!

সেদিনই ওর বন্ধু রয়ের সঙ্গে দেখা করল। রয় সম্প্রতি পুলিশ একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট করেছে। মার্শালের বারে ওকে পাওয়া গেল।

‘রয়, তোমার এস্টেল স্যাম্পসনের কথা মনে আছে?’

‘মনে হয় ওর সাথে স্কুলে পড়তাম।’

‘ও অনেক ছোট থাকতেই খুন হয়ে যায়। দশ বছরেরও আগে সেটা।’

‘ও, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ওকে সম্ভবত গলা টিপে খুন করে, সঠিক জানি না। আর ওকে কে খুন করেছে সেটা সম্ভবত কখনও জানা যায়নি।’

‘ঠিক। ঐ মেয়ের কথাই বলছি। এখন আমার কিছু আইনি পরামর্শ দরকার।’

‘এখন বোলো না তুমি ওকে হত্যার ব্যাপারে কনফেশন করবে।’ হাসতে হাসতে বলল রয়।

‘এটাকে তুমি কিছুটা কনফেশনের মতোই বলতে পারো।… আমি জানি কাজটা কে করেছে, রয়। আমি সবসময়ই জানতাম।’

ড্রিঙ্কে চুমুক দিয়ে রয় ওর গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল ডেভিডের দিকে। ‘তুমি জানতে?’

‘যেদিন ঘটনা ঘটে সেদিন আমি ওখানে লোকটাকে দেখেছি। এতদিন ও এলাকায় ছিল না। কিন্তু এখন আবার ক্যাপস্টোনে ফিরে এসেছে। কেলার নামে কাউকে চেনো? সারা এলাকায় ঘুরে বেড়াত। আমার মনে হয় ও আগে নির্ঘাত জেল খেটেছে!’

‘মনে পড়েছে। একটু রহস্যময় ছিল ব্যাটা। এখন ফিরে এসেছে আবার। দেখেছি ওকে।’

‘কেন আবার ফিরেছে? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে?’

‘আরে মিয়া আস্তে আস্তে!’ রয় একটা সিগারেট ধরাল। বক্রদৃষ্টিতে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ডেভিড ধীরে ধীরে ওকে সবকিছু খুলে বলল। যা এর আগে কাউকে বলেনি। কোনও কিছুই বাদ দিল না।

‘আর এখন শালা আবার এসেছে।’ উত্তেজনায় ডেভিডের কণ্ঠে কাঁপন ধরলো। ‘কেন? কীসের জন্য?’

‘তোমার সব কথা সত্যি হলেও এগুলো প্রমাণ করা অনেক কঠিন হবে। তুমি কি নিশ্চিত কেলারই সেদিন ঝোপঝাড় ভেঙে পালাচ্ছিল? সবার আগে তোমাকে এই প্রশ্নটাই করা হবে।’

‘তোমার মনে হয় এমন একটা ঘটনা আমি ভুলে যাব?’

‘তারপরও মনে হয় না তোমার কথা ধোপে টিকবে।’

‘কিন্তু একটা কিছু তো করতেই হবে।’ ফিসফিসিয়ে বলে উঠল ডেভিড। ‘ও একটা খুনি। ছোট্ট এক মেয়েকে খুন করেছে।’

‘এখন আর এসব বলে লাভ নেই। আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘তাহলে শেষ একটা কথা বলি। দেরি হলেও ও একটা খুনি। একশো বছর পেরিয়ে গেলেও হারামজাদা একটা খুনি। সময়ের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না। সময় কখনও এস্টেলকে আর জীবিত আনতে পারবে না। হয়তো কিছু করতে পারব না, কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো- আমি জানি ও ঠিক কী করেছে।’

‘বোকার মতো কিছু কোরো না, ডেভিড। আইন ওকে নির্দোষ হিসেবেই দেখে। তুমি ওর কিছু করলে আইন তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে।’

‘ওর ফেরার তাৎপর্যটা বুঝতে পারছো না। ও হয়তো কিছুদিন পর আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। এটাই আমাদের সুবর্ণ সুযোগ।’

‘তুমি নিশ্চিত ওই সেই লোক?’

‘অবশ্যই! নিজ চোখে ওকে ঝোপঝাড় দিয়ে পালাতে দেখেছি।’

‘তাহলে এই পালানোর ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? যখন ওর একটা মাত্র পা!’

‘ওর একটা পা নেই?’ সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।


***


পরদিন দেখা গেল সত্যিই কেলারের এক পা নেই। ডান পায়ের হাঁটুর পর সবকিছু উধাও। ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করে। অধিকাংশ সময় কেলার অ্যাভিনিউতে কাটায়। দু’জনের চোখাচোখি হয়, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে।

কী জন্য ফিরে এসেছে ও? বারবার নিজেকে এ প্রশ্নই করছে ডেভিড। কেলার যদি জানে সেদিন এখানকার কারও কাছেই ওর অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, তাহলে আবার কোন সাহসে ফিরে এলো? নাকি বিষয়টা নিয়ে সে সম্পূর্ণ উদাসীন?

লোকটাকে যত দেখছে তত এস্টেলের হত্যার বদলা নিতে পাগল হয়ে উঠছে ডেভিড। পুলিশ কিছু করবে না। ওকেই যা করার করতে হবে।

কেলারের গতিপ্রকৃতি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল ও। ব্যাটা রাতের বেলা মাউন্ট ব্রাঞ্চ সিমেট্রিতে জিম কারসনের দোকানে বিয়ার খেতে যায়। মধ্যরাতে বের হয়ে অ্যাভিনিউর দিকে হাঁটা শুরু করে, ওখান থেকে নিউটন ক্রীকের এক পরিত্যক্ত কেবিনে রাত কাটায়।

ওই রাতে ছায়ার আড়ালে অবস্থান নিল ডেভিড। ঠাণ্ডা মাথায় নিজের পরিকল্পনার ব্যাপারে ভাবতেই মনে হলো উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ড ফেটে যাবে। উথাল-পাথাল শিহরণ ওর সারা শরীরে নেচে বেড়াচ্ছে।

কারসনের ওখান থেকে বেরিয়ে এল কেলার, ক্রাচ বাঁকিয়ে পিছনের দরজাটা ঠেলা মেরে লাগালো। আগে কেলারকে দেখেছিল তারচেয়ে এখন অনেক বেশি শুকিয়ে গেছে। হেঁটে চলছে কেলার, ওর পা আর ক্রাচের সমন্বয়ে পথচলায় সৃষ্টি হয়েছে অদ্ভুত এক ছন্দ। ওর হাতগুলো যেন বৈঠা চালাচ্ছে। সে তিনটা বিল্ডিং অতিক্রমের পর ডেভিড ওর পিছু নিলো।

সিমেট্রি অতিক্রম করে দু’জন বিজনেস ডিসট্রিক্টে ঢুকল। একে একে পার হলো ফ্যাক্টরি, গুদামঘর আর ব্রিকইয়ার্ড। ফ্রেইট ট্র্যাকের উপর পরিত্যক্ত বক্স-কার, কুয়াশায় আড়ালে ওগুলো দেখে মনে হয় যেন একেকটা পাহাড়। কেলারের ক্রাচের শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

শালা জানে আমি ওকে অনুসরণ করছি! মনে মনে ভাবল ডেভিড। ঘন কুয়াশায় কেলারের অবয়বটা ধীরে ধীরে প্রেতাত্মার মতো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চোখের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে, এবার কানের সাহায্য নিতে হবে। এ মুহূর্তে কেলারকে অনুসরণের একমাত্র উপায় ওর ক্রাচের আওয়াজ শোনা।

একসময় শব্দও মিলিয়ে গেল। কেলার চলে গেছে। ডেভিডের পায়ের নিচে স্যাঁতস্যাঁতে মাটি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। বক্রদৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।

সামান্য দূরেই বড়সড় এক পুকুর। ড্র ব্রিজের অবয়ব হালকা বোঝা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে পানির কলকল শব্দ, নিশাচর পাখির ডাক। ডালপালা সরিয়ে ধীরে ধীরে ও পুকুরটার কাছে যেতে লাগল।

‘ইয়েস?’ কুয়াশার আড়াল থেকে শোনা গেল শীতল একটা কণ্ঠস্বর! তারপরই আবির্ভূত হলো সেই কণ্ঠস্বরের মালিক। ওর নিপুণ হাতগুলোর ছোঁয়ায় যেন ক্রাচ দুটোর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে।

ডেভিড একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের ভিতর ভয় আর ক্রোধ ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘তুমি আমাকে অনেক দূর থেকে ফলো করে আসছো।’ বলে উঠল কেলার।

‘অনেক দূর থেকেই তোমাকে ফলো করছি, কতটা দূর তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’ ডেভিডের তীর্যক উত্তর। হাত দুটোকে কোটের পকেট থেকে বের করে আনছে।

‘কেন?’

‘তুমি জানো কারণটা।’

কেলার ওকে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। ক্রাচের উপর চালান করল নিজের শরীরের পুরো ভার। ‘নির্ঘাত তখন অনেক ছোট ছিলে।’

‘কিন্তু কিছুই ভুলিনি।’

‘আমিও ভুলিনি।’

‘তুমি কেন আবার ফিরে এসেছো?’

‘মনে চাইলে আসব না কেন? আমার মতো নিষ্পাপ মানুষের ভয় পাবার কী আছে?’

‘নিষ্পাপ?’

‘অবাক হয়ে গেলে নাকি?’

‘আমি তোমাকে ওদিন দেখেছিলাম।’

‘তুমি আমাকে দৌড়তে দেখেছিলে। এতটুকুই। মনে আছে?’

কেলারের চেহারার দিকে তাকাতেই ডেভিডের কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে।

‘আমি যাওয়ার অনেক আগেই মেয়েটা মারা গিয়েছিল।’ কেলারের গলার আওয়াজ অদ্ভুত রকমের শীতল, সেখান থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে তিক্ততা। ‘হলপ করে বলতে পারি মেয়েটা গাছ থেকে পড়ে মারা যায়। ওকে সামান্য একটু স্পর্শও করিনি। ওই বাসার ভিতর লুটপাটের জন্য পরে নিজেকে হাজারবার ধিক্কার জানিয়েছি। সেই অপরাধের কথা কখনও অস্বীকার করতে পারবো না। বাসার ভিতরে থাকতেই উঠোনে কোনও কিছু পড়ার শব্দ শুনি। বের হতেই মেয়েটাকে দেখি, এরপরই শুনি তোমার চিৎকার। তখন আর দৌড়নো ছাড়া উপায় ছিল না।’

‘দৌড়ে অনেক দূর গিয়েছিলে।’

‘পুরো ব্যাপারটা অনেক খারাপ দেখাচ্ছিল। এমনকী তুমিও ভেবেছিলে আমিই ওকে খুন করেছি। তাই না?’

‘তাহলে এতগুলো বছর…’ ডেভিড বলল। ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে ব্যাপারটা নিয়ে আর কাউকে বলিনি।’ এরপর এক অপার্থিব অনুভূতি।… প্রথমে মনের ভিতর প্রতিক্রিয়া শুরু হলো, তারপর যেন ছড়িয়ে পড়ল পুরো শরীরে। ওর সবগুলো ধমনী যেন একযোগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। প্রতিশোধের আগুন দপ করে নিভে গেল, পশ্চাদপসরণ যেন সারা শরীরে অদ্ভুত এক শীতলতা ছড়িয়ে দিল।

এখন এতগুলো বছর পর, ও সবকিছু ভুলে যেতে পারে। অবিশ্বাসের চোটে মাথা ঝাঁকাতে লাগলো, কেননা গত দশ বছরে এই প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো নিজের ভিতর কোনও টেনশন নেই।

‘তো কী ভাবছ? সবকিছুর এখানেই শেষ?’

ডেভিড ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

‘মনে করো সবকিছু এতই সোজা? একটু আগে জানতে চেয়েছিলে কেন ফিরে এসেছি। ফিরে এসেছি তাকে খুঁজতে যে আমাকে নিজে থেকে খুঁজে বের করবে। জানতাম তুমি এলাকায় থাকলে আমার কাছে আসবেই।’

‘চেয়েছিলে যেন তোমার কাছে আসি?’ ডেভিডের আরও একবার বিস্মিত হবার পালা।

‘একদম। তোমাকে ধরার ব্যাপারে অনেক আশায় ছিলাম। এখানে ফিরে এসেছি তোমার সাথে পুরানো কিছু মীমাংসা করতে। সেদিন প্রচণ্ড জোরে চিৎকার দাও তুমি। তোমার জন্যই ওদিন আমি পাগলের মতো দৌড়তে বাধ্য হই। আমাকে প্রচণ্ড আতঙ্কিত করে ফেলেছিলে আর পরে আমার পা হড়কে যায়। পা হড়কাতেই গড়িয়ে পড়ি ফ্রেইট ট্র্যাকের উপর। ওদিক দিয়ে একটা ট্রেন যাচ্ছিল। ট্রেনটা সঠিক সময়ে ধরতে পারি কিন্তু ট্রেনটাও আমাকে ধরে ফেলে। ট্রেন ধরে ঝুলে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না, ততক্ষণে পা হড়কে আমার ডান পা ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছে।’

ডেভিড কেলারের ডান হাঁটুর দিকে তাকাল।

‘কিন্তু আমি…’ ডেভিড কথা শেষ করতে পারল না। আচমকা কেলারের একটা ক্রাচ উপরের দিকে উঠে ওকে সজোরে ধাক্কা মারল। তারপরই সেটা নির্দয়ভাবে আঘাত হানল ওর মাথায়! ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল ডেভিড, গড়াতে গড়াতে চলে গেল বাঁধের উপর। পানি প্রবাহের শব্দ এখন স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, ঠিক ওর নিচে! হতভম্ব, অর্ধ-সচেতন ডেভিডের সামনে এসে আবির্ভূত হলো এক উন্মাদ কেলার! কুয়াশায় যার বিদঘুটে শরীর দেখতে ভয়াবহ লাগছে! ছুটে আসছে ও, নিজের পা হারানোর জন্য যে দায়ী তার উপর প্রতিশোধ নিতে! ক্রাচগুলো যেন ভয়ংকর কোনও অস্ত্র! হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিল কেলার। এমন সময়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। হাতে একটা ক্রাচ এখনও ধরা, বর্শার মতো সেটাকে হাত দিয়ে ঘুরাচ্ছে। খানিক পর তথাকথিত বর্শা আঘাত করল ডেভিডের মাথার পাশে নরম মাটিতে। ক্রাচ কেলারের হাত থেকে ছুটে পুকুরের পানিতে ডুবে গেল। পঙ্গু কেলার ততক্ষণে ডেভিডের শরীরের উপর চড়াও হয়েছে। অনিবার্যভাবে দু’জনই একসাথে ক্রাচের মতো করে পুকুরের পানিতে পড়লো! আলোড়ন সৃষ্টি হলো কালো পানিতে। কেলারের শক্তিশালী আঙুল সব ডেভিডের গলায় চেপে বসেছে।

চারপাশে পানির চাপ অনুভব করল ডেভিড, কেলার যেন ওর উপর চড়ে বসা বিশাল এক মাছ। ওকে ঠেলে আরও নিচের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে, ওদিকে পানির চাপে ফেটে যাচ্ছে ফুসফুস। বহু কষ্টে ডেভিডের হাতজোড়া কেলারের গলা চেপে ধরতে পারলো। পরস্পরের বজ্র-আঁটুনিতে আটকা পড়েছে ওরা। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে পুকুরের নিচের দিকে, আরও নিচে… আরও নিচে…

বেশ খানিকক্ষণ পর পুকুরের উপর আর কোনও মানুষকে দেখা গেল না। শুধু একটা ক্রাচ একলা সাঁতার কেটে চলে গেল ইস্ট রিভারের দিকে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply