বিতর্কের সূত্রপাত সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের একটি মন্তব্য কেন্দ্র করে। অস্কার-যাত্রার ছবি নির্বাচনে গঠিত জুরিবোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, সুজিতের ছবিটি জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে। ছবিটি বেশ দীর্ঘ। ছবিতে যে ব্রিটিশ বিদ্বেষ দেখানো হয়েছে, তা বিশ্বায়নের যুগে কাম্য নয়।
এ নিয়ে কার্যত দ্বিধাবিভক্ত ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের অস্কার আসরের জন্য ভারত থেকে শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়েছে পি এস বিনোতরাজের তামিল ছবি ‘কুঝঙ্গল’কে।
সুজিত সরকারের পরিচালনায় ‘সরদার উধাম’ ও অমিত মসুরকরের ‘শেরনি’-ও ছিল এই দৌড়ে। কিন্তু হাইপ্রোফাইল এই দুটো ছবি, বিশেষ করে সর্দার উধামকে টপকে ‘কুঝঙ্গল’ কীভাবে ও কেন মনোনীত হলো- এ নিয়ে জল্পনার রেশ কাটতে না কাটতেই এলো ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের এই বিস্ফোরক।
ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্যের ছবি অস্কারে জমা দিলে ফল হবে না- জুরিবোর্ড কি তবে এমনটাই ভেবেছিল?
আনন্দবাজারের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুরিবোর্ডের অন্যতম সদস্য অভিনেত্রী অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অবশ্য নাকচ করেছেন সেই সম্ভাবনা।
অনন্যার ভাষ্য, ইন্দ্রদীপদা যা বলেছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত মত। জুরিতে এরকম কোনো আলোচনা হয়নি। গল্প বলা, চিত্রনাট্য, ক্যামেরার কাজ এবং আরও অন্য বিভাগে ‘কুঝঙ্গল’কে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেটা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত।
ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফিরদৌসুল হাসান একে বিতর্ক তৈরির পাঁয়তারা হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, কোনো জুরি সদস্যের এমন বলা ঠিক নয়।
এ নিয়ে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও মুখ খুলেছেন সর্দার উধামের পরিচালক সুজিত সরকার। বিচারকের রায় তিনি পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
দ্বিধাবিভক্ত দুই পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় ও কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ও। প্রথমজন তথ্যগত অজস্র ভুলের দোষে সিনেমাটির অস্কার-যাত্রা সমর্থন করেন না। দ্বিতীয়জন আবার যারপরনাই মুগ্ধ সিনেমাটির নির্মাণ নিয়ে!
কিন্তু দুজনেই একটি জায়গায় এসে একমত, সর্দার উধাম ‘ব্রিটিশ-বিদ্বেষী’ নয়! লড়াইটা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল- এমনটা মনে করিয়ে দেন কমলেশ্বর।
ওদিকে অনিকেত বলেছেন আরও চাঁছাছোলা ভাষায়, কেউ যদি বলে থাকে ছবিতে ব্রিটিশদের উপরে ঘৃণা দেখানো হয়েছে, তা হলে সে মূর্খের মতো কথা বলেছে। ব্রিটিশরা জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। তারা আমাদের দেশকে লুটে নিয়ে গিয়েছে। এগুলোর কোনোটাই মিথ্যে নয়।
ইন্দ্রদীপের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত নন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। কমলেশ্বরের মতে, ‘‘ছবিতে স্পষ্ট ভাবে দেখানো হয়েছে, ব্যক্তিগত ক্রোধ, জাতিগত বিদ্বেষের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়নি। তখনকার কমিউনিস্টদের কথাও যদি বলি, তাঁরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রিটিশদের প্রতি কোনও বিদ্বেষ তার মূলে ছিল না।’’ অনিকেত বলেছেন, ‘‘কেউ যদি বলে থাকে ছবিতে ব্রিটিশদের উপরে ঘৃণা দর্শানো হয়েছে, তা হলে সে মূর্খের মতো কথা বলেছে। ব্রিটিশেরা জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। তারা আমাদের দেশকে লুটে নিয়ে গিয়েছে। কোনওটাই মিথ্যে নয়।’’
‘সর্দার উধম’ কতটা তথ্যনিষ্ঠ ছবি, তা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু অস্কারে এই ছবি কি জায়গা পেতে পারত? সেই প্রশ্নে অনিকেত এবং কমলেশ্বরের ভিন্ন মত। অনিকেতের বক্তব্য, ‘‘ভুল তথ্যে ভরা কোনও ছবিকে বোধহয় অস্কারের মঞ্চে পাঠানো উচিত নয়।’’ কিন্তু কমলেশ্বর বলছেন, ‘‘অন্য ছবিগুলি দেখিনি, তাই ‘সর্দার উধম’ সেরার সেরা কি না বলতে পারব না। তবে অস্কারে যাওয়ার মতো সম্ভাবনা ছিল ছবিটির। এমন পরিচালনা এবং সিনেম্যাটোগ্রাফি দীর্ঘদিন দেখিনি!’’
‘সর্দার উধম’ নিয়ে দর্শকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে যে কোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রে জুরি বোর্ডই শেষ কথা। এ ক্ষেত্রেও তাই।
Leave a reply