হাসান আজিজুল হক মারা গেলেন। কিন্তু থেকে গেলো গল্পে গল্পে গড়া তার বিস্তৃত একটি পৃথিবী। ষাটের দশক থেকে তিনি ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে শুধু গল্পই বুনে গেছেন। প্রখর জীবনবোধে ঋদ্ধ এই শিল্পী মনে করতেন, মানুষের জীবন ও ইতিহাস শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। হাসান আজিজুল হক একবার বলেছিলেন, লেখকরা দেশবাসীর ভাড়াটে ভাঁড় নন যে শুধু আমোদ বিক্রি করবেন।
হাসান আজিজুল হক তার সাহিত্যে ও নির্মাণকৌশলে কখনও রক্ষণশীলতাকে প্রশ্রয় দেননি। শিল্পের মধ্যে সবসময় তিনি সময় ও পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই দর্শন বাস্তবায়নে তিনি ষাটের দশকে উত্থিত নতুন শিল্পধারণার একজন অগ্রগণ্য পথিক হয়ে ওঠেন। তবে বিশ্লেষক চন্দন আনোয়ার বলছেন, এই নতুন আঙ্গিক কালিক পশ্চাৎপদতার কারণেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো বড়ো ঘটনাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। আর এ কারণেই তিনি এই পথে বেশিদিন হাঁটতে পারেননি। হাঁটেননি। চন্দন আনোয়ার বলছেন, স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি নতুন ওই ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। তার এই সংশ্লিষ্টতা ততটুকুই, যতটুতকু সম্পূর্ণ কালিক এবং এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
ষাটের পরে ক্রমশ আরও বিষয়ানুবর্তী হয়েছেন হাসান আজিজুল হক। বিষয়ই তার গল্পের, কাহিনির শরীরি অবয়ব নির্মাণ করেছে। তার শিল্প জীবনে ব্যাপারটা অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন আঙ্গিক নিয়ে আলাদা করে ভাবার কোনো প্রয়োজনই নেই, গল্পই চলতে চলতে তার শরীর গড়ে নেবে, যেভাবে নদী গড়ে নেয় তার শরীর।
বস্তুত হাসান আজিজুল হক সাহিত্যের আঙ্গিককে খুব একটা স্বীকারই করতেন না। তিনি গল্প-উপন্যাস সব ধরনের লেখাকেই গদ্যলেখা হিসেবে উল্লেখ করতেন। ৪০ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি সম্পূর্ণ উপন্যাস লিখেছেন ষাটের পরে। বিখ্যাত, বহুল আলোচিত এবং বিশেষত লেখকের প্রথম উপন্যাস আগুনপাখি প্রকাশিত হয় তার ৬৭ বছর বয়সে। এই একটি উপন্যাস লিখেই তিনি বাংলাদেশ তথা পুরো ভারতবর্ষে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এই বইটি তাকে এনে দিয়েছে জগতজোড়া খ্যাতি।
হাসান আজিজুল হকের জীবনযাপনের ভূগোল বিচিত্র। ভারতবর্ষের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য। জীবনের নানা পর্যায় তিনি কাটিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। শৈশব-কৈশোর পশ্চিমবঙ্গে, যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবনে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা ও পরিণত বয়স থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীতে ছিলেন তিনি।
একটি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং উত্তরকালের চার দশকের বাংলাদেশের উত্থান-পতন ইত্যাদি ইতিহাসের বিস্তৃত পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বসেন হাসান আজিজুল হক। কখনও আপন কাল, দেশ, সমাজ ও মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে অবক্ষয়িত কোনো দর্শন, আমদানি করা আত্মবোধশূন্য সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি তিনি। ঐতিহ্যের জন্য ভিত্তিহীন কোনো ‘ইজম’ বা সংজ্ঞা গ্রহণও করেননি জীবনে। যা ঘটেনি বা ঘটার সম্ভাবনা নেই সেসব নিয়ে না লিখে আমাদের দেশ ও সমাজ যেমন আছে এবং যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই লিখেছেন তিনি। তবে এই অতি সাধারণ ভূগোলবোধও হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক বোধে ঋদ্ধ। মূলত জাতীয়তাবাদী ধারণা নয়, বরং কাহিনির চরিত্র হিসেবে স্বজাতি আর মঞ্চ হিসেবে স্বভূমি তার লেখার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে।
হাসান আজিজুল হক মানবিক লিখেছেন বোধের মুক্তির জন্য। তবে তিনি মনে করতেন সাহিত্য শতভাগ নিরপেক্ষ হতে পারে না। কারণ, সমাজের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। লেখকের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, রুচি-অরুচি যেমন তার লেখায় থাকবে, তেমনি সমাজও দাবি খাটাবে। সম্ভবত এই দর্শনের কারণেই লেখক সাহিত্যে মার্কসবাদের প্রয়োগকে সমর্থন করতেন। তবে সমাজবিপ্লবী সাহিত্যিকের মতো তিনি ম্যাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলার পক্ষে ছিলেন না, বরং শান্তভাবে লক্ষ্যটাকে স্থির করে, লড়াইয়ের ক্ষেত্র ও ধরনটিকে নির্দিষ্ট করে, তারপর লড়াইয়ে নামারই পক্ষপাতি ছিলেন তিনি।
সময়ের অমানবিকতা, অশান্ত রাজনীতি আর অসুস্থ সমাজ নিয়ে আক্ষেপ করে হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, এ রকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য করতেই আমার নিজের ওপরে ধিক্কার জন্মে যায়। যদি গোটা বাংলাদেশের দিকে তাকাই, মানুষের দিকে তাকাই– মানুষকে ছোট করতে করতে আমরা কোথায় নিয়ে ফেলেছি? মানুষকেই যদি আমরা কীটানুকীটে পরিণত করি, তাহলে আমি কোন হিমালয়ের চূড়ায় উঠব?
Leave a reply