আলমডাঙ্গায় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

|

আরিফুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভুগীরা বলছেন, একটি ঘর ও টয়লেট নির্মাণ ব্যয় এক লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও যেন তেন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে এসব ঘর। ডিজাইন মোতাবেক কাজের গুণগত মানও ঠিক রাখা হয়নি। এক নম্বর ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দুই ও তিন নম্বরের ইট। এমন সব অভিযোগ নিয়েই শেষ করা হয়েছে গৃহহীন ২২০টি পরিবারের ঘর ও টয়লেট নির্মাণের কাজ। আর এ কারণে ঘর নির্মাণের মাস না যেতেই ছাউনী দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে ঘরে।

এদিকে গরীবের ঘর নির্মাণে এমন অনিয়মের অভিযোগের বিষয়টি গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও। প্রকল্পটির পরিচালক জানিয়েছেন, ঘটনা অনুসন্ধানে চলতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে তদন্ত দল আলমডাঙ্গাতে আসবেন। তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাদের জমি আছে অথচ ঘর নাই এমন গৃহহীন মানুষদের কথা চিন্তা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে তাদের জন্য গৃহনির্মানে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় আশ্রয়ন প্রকল্প-২। এ প্রকল্পের আওতায় চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ৭৫টি, চলতি বছরের ২২ ফেব্রয়ারি ১৪৫টি ও সবশেষ ৯ মে ৪৬০টি পরিবারকে গৃহনির্মাণ ও টয়লেট নির্মাণ বাবদ এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেন সরকার।

প্রকল্পের কার্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী আলমডাঙ্গা উপজেলাতে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় বরাদ্দ আসা গৃহনির্মাণ কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। একই সাথে তৃতীয় দফায় বরাদ্দ আসে আরো ৪৬০টি পরিবারকে গৃহনির্মাণ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৩০ জুন পর্যন্ত।

কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ফেজে বরাদ্দ আসা গৃহনির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে নামকাওয়াস্তে। অধিকাংশ ঘরে নির্মাণে রয়েছে ত্রুটি। ২৭৫ বর্গফুটের ঘর নির্মাণে এক নম্বর ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দুই নম্বর ইট। দশমিক ৩৬ এমএম’র পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দশমিক ৩২ এমএম’র ঢেউটিন। নকশায় ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের খোয়া ও চিপ। পিলারও দেয়া হয়েছে নিম্নমানের। মাত্র তিনটি রডে বানানো হয়েছে পিলার। ছয়টির বদলে জানালা হয়েছে দুটি।

ঘরের বরাদ্দ পাওয়া আলমডাঙ্গার বেলগাছি ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের টুটুল মিয়ার অভিযোগ, ঘর নির্মাণে সরকার এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও ঘরের অবকাঠামো দেয়া হয়েছে খুব নিম্নমানের। ঘরের মেজে এমন দায় সারা ভাবে করা হয়েছে মাঝখানে উঁচুর পরিবর্তে হয়েছে নিচু। টয়লেটের কাজও শেষ করে দিয়ে যায়নি শ্রমিকরা।

জামজামি ইউনিয়নের ভোদুয়া গ্রামের আনজিরা বেগমের অভিযোগ, ঘরের বেড়া ও চালে শাল, গর্জন, জারুল, কড়াই, শিশু, তাল, পিতরাজ, দেবদার বা আকাশমনি কাঠ ব্যবহারের কথা। কিন্তু শুধুমাত্র দেবদার আর নিম্নমানের মেহগনি ব্যবহার করা হয়েছে। আর তারকাটা, পেরেক, তার, কব্জা, ছিটকানি, স্ক্রু, ওয়াশার, মেঝের রঙ এসব নেয়া হয়েছে আমাদের কাছ থেকে। মালামাল আনা-নেয়ার জন্যও তাদেরকে টাকা গুনতে হয়েছে।

প্রায় অভিন্ন অভিযোগ, নাগদাহ ইউনিয়নের জহুরুলনগর গ্রামের তাবিদা খাতুনের। তার দাবি ঘরের সমস্ত মালামাল সরকারের দেওয়ার কথা থাকলেও আমাদেরকে গুণতে হয়েছে টাকা। এছাড়া ঘরের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের খাওয়ার টাকাও গুনতে হয়েছে আমাদেরকে। সব মিলিয়ে এই ঘর নির্মাণে আমাদেরও খরচ হয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।

আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার আন্না খাতুনের অভিযোগ, নতুন ঘর পেলাম। কিন্তু টয়লেটের পিলার ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এদিকে ঘরের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরের ভিতরে পানি জমছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, গরীবের ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়মের অভিযোগটি শেষমেষ প্রকল্প পরিচালকসহ গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও। এমন অবস্থায় বেশ কিছু এলাকায় তড়িঘরি করে নিম্নমানের টিনও বদল করে পুনরায় নতুন টিনও লাগানো হয়েছে। অনুসন্ধানে এমন সত্যতাও মিলেছে।

আশ্রয়ন প্রকল্প-২ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, কাগজে কলমে আমি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কোথায় কি কাজ হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে তা, সেটি নিম্নমানের হচ্ছে, নাকি ভাল হচ্ছে, আমার তা জানা নাই। এটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকতাই ভাল বলতে পারবেন।

আলমডাঙ্গা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে গৃহহীনদের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানদেরও ক্ষোভ রয়েছে। তাদের দাবি প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সাথে প্রকল্পের আহ্বায়ক ইউএনওকে সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।

তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহাত মান্নান আলমডাঙ্গা উপজেলাতে শতভাগ কাজ ভাল হওয়ার দাবি করেন। তিনি জানান, অন্য এলাকার চেয়ে আমার এলাকার কাজ অনেক ভাল হয়েছে।

আলমডাঙ্গাতে কাজের গুণগত মান নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অভিযোগের পর কিছু এলাকায় টিন বদল করা হয়েছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দুই একটি জায়গায় মিস্ত্রির ভুলে এমনটি হয়েছে। আমি জানার পর টিনগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছি।

প্রকল্পের কাজে এমন দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব ও আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন জানান, আলমডাঙ্গাতে গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়মের ব্যাপারে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসককে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। একই সাথে আগামী সপ্তাহেই ঢাকা থেকে একটি তদন্ত দল সরেজমিন পরিদর্শন করে তদন্ত করবেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply