আনা মন্টেস: আমেরিকার গোমর ফাঁস করে দিয়েছিল যে গুপ্তচর

|

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। শীতলযুদ্ধ চলাকালীন এই দুই পরাশক্তির মধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল চরমে। কিউবান বিপ্লবের পরে ফ্রিদেল ক্যাস্ত্রোর হাত ধরে সোভিয়েত বলয়ে পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়ে মার্কিন মুল্লুকের এক নিঃশ্বাস দূরের দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি কিউবাও ছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের সমান নজরদারিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ কিউবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আনা মন্টেসকে। যার খ্যাতি ছিল কিউবার রানি হিসেবে। কারণ, মন্টেসের কাছে কিউবা ছিল হাতের তালুর মতো চেনা। মার্কিন ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) গোয়েন্দা বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন মন্টেস। স্নায়ুযুদ্ধকালীন প্রায় দুই দশক ধরে ‘ডাবল এজেন্ট’ হয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি কিউবার পক্ষেও গুপ্তচরবৃত্তি করে আসছিলেন তিনি। এই দুই দশকে তিনি কিউবায় মার্কিন গোয়েন্দা কার্যক্রমের প্রায় পুরোটাই ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

১৯৯৭ সালে আনা মন্টেসের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিচ্ছেন তৎকালীন সিআইএ ডিরেক্টর।

শুধু কী তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপন ও ব্যয়বহুল প্রকল্প গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের অস্তিত্বও প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। যা কিনা রাশিয়া, চীন ও ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতো। এসব কারণেই আনা মন্টেসকে বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক গুপ্তচর।

কিন্তু আনা মন্টেস কেন মার্কিন গোয়েন্দা হয়েও প্রতিপক্ষ কিউবার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করলেন?

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আনা মন্টেস অন্যান্য বাঘা বাঘা গোয়েন্দাদের মতো ব্যক্তিগত স্বার্থে প্ররোচিত ছিলেন না। বরং মতাদর্শিক কারণেই কিউবার হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী ছিলেন মন্টেস।

১৯১২ সালে ব্যানানা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়া দখল করে। মার্কিন সমর্থনে নিকারাগুয়ায় উত্থান হয় সোমোজা রাজনৈতিক পরিবারের। সোমোজা পরিবার তখন থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত নিকারাগুয়া শাসন করে। ১৯৭৯ সালের বিখ্যাত স্যান্ডিনিস্তা আন্দোলনে নিকারাগুয়ান যুবকদের হাতে পতন হয় সোমাজা পরিবারের। জনপ্রিয় সেই নিকারাগুয়ান বিপ্লব সারা বিশ্বের বহু যুবক-যুবতীকে অনুপ্রাণিত করেছিল। যাদের মধ্যে ছিলেন ২২ বছর বয়সী আমেরিকান নাগরিক আনা বেলেন মন্টেসও।

তবে আনা মন্টেসের মধ্যে মার্কিন সম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তৈরি হয় আরও আগে। বলা যেতে পারে ছোট বেলা থেকেই। কারণ, মন্টেস তার পৈতৃক ভূমি পুয়ের্তো রিকোতে মার্কিন দখলদারিত্ব কখনোই মেনে নিতে পারেননি।

মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্যটি হচ্ছে, মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করার আগেই আনা মন্টেস কিউবার হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। আর ঘূণাক্ষরেও এই ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি তারা।

এফবিআই এর দেয়া তথ্য অনুসারে, কিউবা তাকে গুপ্তচর হিসেবে তখন নিয়োগ দিয়েছিল, যখন তারা অনুভব করেছিল, মন্টেস কিউবার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। বিশেষ করে, প্রতিরক্ষা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেলের একটি প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, নিকারাগুয়ায় মার্কিন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আনা মন্টেস ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এক সহপাঠী প্রাথমিকভাবে মন্টেসের সাথে যোগাযোগ করে এবং সেই বন্ধুই মন্টেসকে একজন কিউবান গোয়েন্দা এজেন্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কিউবার সেই গোয়েন্দা এজেন্টের সাথে নিউইয়র্ক সিটিতে এক নৈশভোজে মন্টেস নিকারাগুয়াকে ‘সাহায্য’ করার জন্য কিউবার হয়ে কাজ করতে দ্বিধাহীনভাবে সম্মত হন। অর্থাৎ আনা মন্টেস কিউবা তথা নিকারাগুয়াকে সাহায্য করার উদ্দ্যেশেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন।

১৯৮৪ সালের দিকে আনা মন্টেস বিচার বিভাগের সাধারণ একজন কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং একই সময়ে মার্কিন ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন।

১৯৮৫ সালে ডিআইএতে নিয়োগ পাওয়ার পর মন্টেস তার বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে খুব দ্রুত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন। আনা মন্টেস একের পর এক পদোন্নতি পেয়েই যাচ্ছিলেন যতক্ষণ না পেন্টাগন তাকে কিউবা বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৯২ সালে মন্টেসকে কিউবার দায়িত্ব দেয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থায় যোগ দিয়েই আনা মন্টেস কিউবার গুপ্ত বন্ধুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন তথ্য ফাঁস করা শুরু করেন। প্রায় দুই দশক ধরে নির্বিঘ্নে এই কাজ করে গেছেন তিনি। দীর্ঘ এই সময়ে তাকে ধরাতো দূরে থাক, সন্দেহও করতে পারেনি দুনিয়ার সবচেয়ে ধূর্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা।

এ ক্ষেত্রে আনা মন্টেস ছিলেন তার সহকর্মীদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। কারণ, তথ্য বহন করার কাজে মন্টেস বিকল্প কোনো মাধ্যম ব্যবহারের ঝুঁকি নেননি। সেক্ষেত্রে তিনি তার প্রখর মুখস্তবিদ্যাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। দিনের বেলা মন্টেসের কাজ ছিল চুপচাপ সমস্থ নথি মুখস্ত করে ফেলা এবং রাতে বাড়িতে গিয়ে সেসব তথ্য গোপন একটি ল্যাপটপে সাংকেতিক ভাষায় লিখে রাখা।

আনা মন্টেসের এই কোডেড বার্তাটি উদ্ধার করেছিল এফবিআই।

প্রায় দুই দশক ধরে আনা মন্টেস ওয়াশিংটন ডিসির রেঁস্তোরায় কয়েক সপ্তাহ পরপর কিউবার এজেন্টদের সাথে দেখা করতেন। আর পেজারের মাধ্যমে তাদের কাছে গোপন তথ্য সম্বলিত কোডেড বার্তা পৌঁছে দিতেন।

কিউবা সম্পর্কিত এত গোপন নথিগুলো ঠিক কীভাবে ফাঁস হচ্ছে এটি বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের। বছরের পর বছর খোঁজার পর ২০০০ সালের দিকে এসে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মন্টেসকে প্রথম সন্দেহ করা শুরু করে। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন গোয়েন্দারা মন্টেসের বাড়িতে অনুসন্ধান করে তার বিছানার নীচ থেকে একটি ল্যাপটপ এবং সেই ল্যাপটপে ফাঁস হওয়া তথ্যগুলোর অস্তিত্ব দেখতে পান। অবশেষে গ্রেফতার করা হয় আনা মন্টেসকে।

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিমূলক ষড়যন্ত্রের দায়ে মন্টেস দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। তবে ২০ বছর কারাভোগের পরে মুক্তি দেয়া হয় মন্টেসকে।

আনা মন্টেসের বয়স এখন প্রায় ৬৬। ধূসর চেহারায় পরেছে বার্ধক্যের ছাপ। দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি মিললেও আগামী পাঁচ বছর তাকে সুক্ষ নজরদারির মধ্যেই থাকতে হবে। নানা বিধি-নিষেদের বেড়াজালে এক প্রকার বন্দি থাকতে হবে তাকে। বাকি জীবনটা তাই পৈতৃক ভিটা পুয়ের্তো রিকোতেই কাটাতে চান তিনি। তবে আনা মন্টেস মোটেই তার মতাদর্শ থেকে ফিরে আসেননি। মুক্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মন্টেস ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি এখনও কিউবার কথা ভাবছেন, ভাবছেন পুয়ের্তো রিকোর কথা।

তিনি তার আইনজীবীর মাধ্যমে গণমাধ্যমকে একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যারা আমার দিকে মনোনিবেশ করতে চান, তাদেরকে আমি পুয়ের্তো রিকোর জনগণের গুরুতর সমস্যা কিংবা কিউবার ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলা মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নজর দিতে বলবো।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আনা মন্টেস নিশ্চিতভাবেই ঘরের শত্রু বিভীষণ। কিন্তু কিউবার জন্য তিনি আসলেই রানি! কিউবার জন্যে তিনি এমন একজন, যিনি এককভাবে কিউবাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অসংখ্য আক্রমণ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন।

গ্রন্থনা: মুনিম রাব্বী

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, স্পাই স্কেপ ও এফবিআই ওয়েবসাইট।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply