ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ বলা হয় উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগকে। আর সেখানেই নেই চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের ইতিহাসের সর্ব্বোচ্চ গোলের মালিক আর্জেন্টাইন ফুটবল যাদুকর লিওনেল মেসি। ফরাসি ক্লাব পিএসজি ছেড়ে কয়েকমাস আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যোগ দিয়েছেন ‘এলএমটেন’। এর কারণেই ১৯ বছর পড় মেসিকে ছাড়া শুরু হবে ২০২৩/২৪ এর ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।
২০০৪ সালের ৮ ডিসেম্বর মাত্র ১৮ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক হয় আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকরের। এরপর শুধুই ইতিহাস গড়েছেন। ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছেন, দেখিয়েছেন বাম পায়ের জাদু। চ্যাম্পিয়নস লিগে ইতিহাসে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সর্বাধিক গোলের মালিক এই আর্জেন্টাইন মহাতারকা। ৮৩ ম্যাচ থেকে গোল করেছেন ৭৮ টি। স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা।
চ্যাম্পিয়নস লিগে মেসির স্মরণীয় ম্যাচ:
১. বার্সেলোনা-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড: ২০১১ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মুখোমুখি হয়েছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা। এই ম্যাচে বার্সেলোনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। আর্জেন্টাইন জাদুকরের একক নৈপুণ্যে রেড ডেভিলদের ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি। ৩ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বার্সাকে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা উল্লাসে মাতান এলএমটেন। বিশ্লেষকদের মতে মেসির সর্বকালের সেরা তিনটি পারফরমেন্সের মধ্যে এটি অন্যতম। ম্যাচ শেষে রেড ডেভিল কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন লিওনেল মেসির ভূয়সী প্রশংসা করেন। অতিমানবীয় পারফরমেন্সের কারণে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও জিতেছিলেন মেসি।
২. রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা: ২০১১ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয়েছিল বার্সেলোনা। কাতালান ক্লাবের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি প্রথম গোল করে বার্সাকে এগিয়ে নিয়েছেন বটে, কিন্তু বিস্ময় যে এখনও বাকি। সার্জিও বুসকেটসকে পাস দিয়ে নিজেই দৌড়ে এসে চার ডিফেন্ডার কাটিয়ে এবং খোদ ইকার ক্যাসিয়াসকে ফাঁকি দিয়ে লিওনেল মেসি অতিমানবীয় গোল করে বসলেন। সব লিগ মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে কম গোল করেননি মেসি। কিন্তু মাদ্রিদের বিপক্ষে তার এ গোলটি যে সবথেকে সেরা, তা বলাই বাহুল্য। এদিন, রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে মেসির জোড়া গোলেই ২-০ ব্যবধানে জয় নিশ্চিত হয় বার্সার। পুরো ম্যাচে মাদ্রিদ সমর্থকদের স্তব্ধ করে রেখেছিলেন এলএমটেন। ক্রীড়া বিশ্লেষকদের মতে, চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে একক নৈপুণ্যে যদি কেউ ম্যাচ জিতিয়ে থাকে মেসির আজকের ম্যাচ তার বড় উদাহরণ।
৩. মেসির এক ম্যাচে পাঁচ গোল: কোনো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা সহজ কথা নয়। চার গোল তো আরো কঠিন, আর পাঁচ গোলের সুপার হ্যাটট্রিক তো অভাবনীয়। কিন্তু লিওনেল মেসি সেই অভাবনীয় কাজকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে বার্সেলোনার দেয়া ৭ গোলের মধ্যে ৫টি গোল করেছিলেন মেসি। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হলো, ভাগ্য সহায় হলে সেদিন বায়ার লেভারকুসেনের জালে ৬ গোল দিয়ে ফেলেছিলেন মেসি। তবে একটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হয়েছিল।
৪. বার্সেলোনা-আর্সেনাল: উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে আর্সেনালের এমিরেটস স্টেডিয়ামে ২-২ সমতায় থাকার পর দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে খেলতে নামে বার্সা। ম্যাচের ১৬ মিনিটেই বেন্ডটনারের গোলে পিছিয়ে পড়ে বার্সা। এরপরেই ফুটবল সৌন্দর্যের রুপকথার রাজকুমার লিওনেল মেসির ম্যাজিক দেখে বিশ্ব। হাফ টাইমের আগেই হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন এই মহাতারকা। শুধু হ্যাটট্রিক করেই থামেননি আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর। এই ম্যাচে একাই ৪ গোল করেছিলেন মেসি। তার একক নৈপুণ্যেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে কাতালান ক্লাবটি। ম্যাচ শেষে গানারদের কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার বলেছিলেন, ন্যু ক্যাম্পে খেলা মানে দু’জন মেসির বিপক্ষে খেলা। সে ইতিহসের সেরা খেলোয়াড়।
৫. বার্সেলোনা-বায়ার্ন মিউনিখ: ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়ানস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে বায়ার্ন মিউনিখের মুখোমুখি হয়ে মেসির বার্সা। এই ম্যাচের আগে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন বায়ার্নের গোলরক্ষক ম্যানুয়েল ন্যুয়ার। লিওনেল মেসিকে হুমকি দিয়ে তিনি বলছিলেন, মাঠে দেখাতে চান কে ‘বস’। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। বায়ার্ন মিউনিখ-বার্সেলোনা ম্যাচে গোটা দুনিয়া দেখেছে কে বস। কোনও গরম গরম বক্তিতা নয়। ফুটবল মহাতারকা লিওনেল মেসি সেদিন গোটা দুনিয়াকে দেখিয়েছিলেন ন্যুয়ার নয়, তিনিই সেরা। একের পর এক আক্রমণে বায়ার্নকে নাজেহাল করে তুলেছিলেন মেসি। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে ৩-০ গোলের বড় জয় এনে দিয়েছিলেন এলএমটেন।
৬. মেসির বিপক্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভয়াল স্মৃতি: ২০০৯ এবং ২০১১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পৌঁছেছিল ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে অদ্ভুতভাবে এই দুই ফাইনালেই হতাশ হতে হয়েছিল বার্সেলোনার কাছে হেরে। ২০০৯ সালে মূলত ফার্গুসনের দল হেরেছিল মেসির দুর্দান্ত নৈপুণ্যের কারণে। ২০১১ সালে ফাইনালেও সেই একই গল্প ফেরত এসেছিল। সেই পুরনো বার্সেলোনা এবং আবারও মেসির অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের কাছে রেড ডেভিলদের নতি স্বীকার করতে হয়েছিল।
ইউরোপে নিজের অর্জনের ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন মেসি। ১৮ বছর ইউরোপের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো মেসি এখন এখন ইন্টার মায়ামিতেক। বিদায় শব্দটি সবসময়ই দুঃখের-বেদনার কষ্টের। এরপরেও ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই চ্যাম্পিয়নস লিগ শব্দটি যখন সামনে আসবে, নিঃসন্দেহে আর্জেন্টাইন এই জাদুকরের নাম সবার আগে চলে আসবে। নিঃসন্দেহে আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকরের ম্যাজিক মিস করবে চ্যাম্পিয়নস লিগ।
/আরআইএম
Leave a reply