যেভাবে বাবার ‘গোপনাস্ত্র’ হয়ে উঠলেন ডেভিড আনচেলত্তি

|

বাবা কার্লো আনচেলত্তিকে ম্যাচের সময় হাত দিয়ে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন ছেলে ডেভিড আনচেলত্তি। ছবি: গেটি ইমেজ।

আহাদুল ইসলাম:

যখনই চ্যাম্পিয়নস লিগের কথা আসে, রিয়াল মাদ্রিদ যেন অসাধারণকে ‘স্বাভাবিক’ করাটা অভ্যাসে পরিণত করেছে। সাম্প্রতিক উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে সেটাই দেখিয়েছে গ্যালাক্টিকোরা। সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচের বাকি মাত্র ১০ মিনিট। প্রতিপক্ষ বায়ার্ন মিউনিখ রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এগিয়ে ছিল ১-০ গোলে। রিয়াল আসর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। প্রাণ যায়-যায় অবস্থা!

ঠিক এমন সময়ে ডেভিড আনচেলত্তি তার বাবা কার্লোকে একটি বিশেষ বদলি করার জন্য বার বার তাড়া দিচ্ছিলেন। ম্যাচে মিডফিল্ড থেকে বক্সে সময়মত রান করা জুড বেলিংহাম ক্লান্তি হয়ে পড়েছিলেন। বায়ার্ন ডিফেন্স তাদের সমস্ত শক্তি তখন ব্যয় করছিলো ভিনিসিয়াস জুনিয়রের গতির বিরুদ্ধে।

কার্লোর ছেলে ডেভিড আনচেলত্তি বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে রিয়ালের খেলোয়াড়দের আরও উপস্থিতি প্রয়োজন। বায়ার্ন ডিফেন্ডারদের মনোযোগ বিভক্ত করার জন্য একজন খেলোয়াড়কে তিনি বদলি হিসেবে নামাতে চাচ্ছিলেন। তার নাম জোসেলু! স্ট্রাইকারের মতো হঠাৎ আক্রমণে সক্ষম তিনি।

প্রাক্তন স্টোক ও নিউক্যাসল ফরোয়ার্ড দ্বিতীয় বিভাগ এসপানিওল থেকে এক মৌসুমের জন্য লোনে রিয়ালে এসেছিলেন। ম্যাচের শেষ দিকে গোল পরিশোধের জন্য স্বাভাবিকভাবেই অনেকই তাকে বদলি হিসেবে নামাতে চাইবেন না! হতাশাগ্রস্ত কোচ সিনিয়র আনচেলত্তি বেঞ্চে তার ছেলের দিকে তাকালো। কার্লোর ছেলে ডেভিড আনচেলত্তি জোর গোলায় বলে উঠলেন ‘জোসেলু দাই! দাই! এই শব্দটি ইটালিয়ান, যার অর্থ বোঝো!

জোসেলু’র দেরিতে করা গোলগুলো মাদ্রিদকে নিয়ে যায় স্বপ্নের ফাইনালে। ছবি: গেটি ইমেজ।

কার্লো শান্ত হয়ে ছেলের আকুতি শুনে রাজি হলেন এবং বললেন জোসেলুকে ওয়ার্ম আপ করতে বলো। ছেলের তুরুপের টেক্কাই বায়ার্নের গোলরক্ষক ম্যানুয়াল নয়্যারের ভুলকে কাজে লাগিয়ে করেন ২টি গোল। সেই সাথে মাদ্রিদকে নিয়ে যান স্বপ্নের ফাইনালে।

জোসেলুকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামানোর সিদ্ধান্ত যে সঠিক, সেটি প্রমাণ করলেন ডেভিড। এভাবেই কার্লোর ছেলে, ডেভিড আনচেলত্তি রিয়ালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে ওঠেন বাবা কার্লোর গোপন অস্ত্র!

একেবারে স্পষ্ট ফুটবল দর্শন না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে রিয়াল মাদ্রিদ ফাইনালে পৌঁছে গেলো?

ডেভিড আনচেলত্তি অনেক সাক্ষাত্কারে স্পষ্ট করেছেন যে তাদের দলের সফল মান্ত্রা হচ্ছে ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’। তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী দলের ফর্মেশন পরিবর্তন করেন। কোন একঘেয়ে দর্শন নেই। ৪-৩-৩ ফর্মেশন দিয়ে যেকোনো ম্যাচ শুরু করলেও, খেলার পরিস্থিতি বুঝে অনেকবার পরিবর্তন করা হয় সেটি।

এক সাক্ষাৎকারে কার্লো আনচেলত্তি ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমি গার্দিওলিসমো কিংবা সারিসমোর মত মতাদর্শে বিশ্বাস করি না। আমি দলের পরিচয়ে বিশ্বাস করি।’ বাবা যেমন বলছে, ছেলেও ঠিক সেই পথেই হেঁটে চলেছেন।

এমন খেলার শৈলীতে অভ্যস্ত হওয়ার পরিবর্তে ইতালিয়ান মাস্টার সাফল্য নিশ্চিত করতে কৌশল তৈরি করেন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়দের প্রয়োজন বুঝে।

একজন বুদ্ধিমান ম্যানেজার হলেন তিনিই, যিনি খেলাটিকে তার খেলোয়াড়দের বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খাইয়ে নেন। তিনি একজন বোকা ম্যানেজারই হবেন, যদি ভিনিসিয়াসের মতো একজন ফরোয়ার্ড দলে থাকার পরও পাল্টা আক্রমণে (কাউন্টার অ্যাটাক)-এ বাজি না ধরেন। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে কার্লো বলেন, আমার কাছে ক্রিশ্চিয়ানো যখন ছিলো, আমি প্রায়ই তার কাছে বল দেয়ার উপায় খুঁজতাম, আমি তাকে ডিফেন্সে যেতে বলতাম না।

রিয়াল মাদ্রিদে ফিরে আসার পর থেকে, আনচেলত্তি প্রতিপক্ষের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, ভুল করতে বাধ্য করা, তাদের উপর চাপ তৈরি করার ওপর বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। বায়ার্ন মিউনিখই প্রথম শিকার ছিলো না মাদ্রিদের।

তবে এই পদ্ধতির সাফল্যের বেশিরভাগই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ডেভিডের কাছে, যিনি বেঞ্চে মাদ্রিদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছেন। ডেভিডই তার বাবাকে ম্যাচের কৌশলে নিয়ে বার বার চ্যালেঞ্জ করতেন, করছেন এবং সামনে করবেন!

বায়ার্নের প্রাক্তন মিডফিল্ডার জাভি মার্টিনেজ, যিনি আনচেলত্তি ও পেপ গার্দিওলা উভয়ের হয়েই খেলেছেন। তিনি বলেন, ‘ডেভিড তার বাবার ধারাবাহিক সাফল্যে যে ভূমিকা পালন করেছে, তা এক কথায় অসাধারণ!

জাভি আরও বলেন, নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন প্রক্রিয়া কখনই থামে না এবং পুরোনো কোচদের জন্য মানিয়ে নেয়া বেশ কঠিন। সেদিক থেকে ডেভিড মাদ্রিদের জন্য মূল্যমান সম্পদ। ম্যাচের পরিকল্পনা বিবেচনায়, ডেভিড কার্লোকে পরিপূর্ণ করে এবং তাকে ফুটবলের নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে। এছাড়াও ডেভিড অবিশ্বাস্য, সব সময় পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আসে, একজন মহান ব্যক্তিত্ব; ঠিক তার বাবার মতো।”

পূর্বে নিজেই ছিলেন একজন ফুটবলার। তবে ডেভিড ছোটবেলা থেকেই জানতেন যে তিনি তার বাবার মতো কোচ হতে চান। তিনি কৌশল বুঝতেন এবং একজন কোচ হিসাবে কীভাবে একটি দলকে সংগঠিত করতে হয় সে সম্পর্কে তার জ্ঞান বেশ ভালো। ইতালির সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলবিদদের একজনের পুত্র হিসেবে ডেভিড ধীরে ধীরে নিজেকে প্রমাণ করছেন, দারুণভাবে।

ক্রীড়া বিজ্ঞানে স্নাতক শেষে, ডেভিড আনচেলত্তি প্যারিস সেন্ট-জার্মান-এ তার বাবার সাথে যোগ দেন। এরপর বায়ার্ন মিউনিখে তিনি তার বাবার সহকারী কোচ হয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই বলেন, তার প্রাথমিক ভূমিকা হল তার বাবাকে একটি ভিন্ন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি দেয়া। রিয়াল মাদ্রিদ স্কোয়াডে তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ডেভিড গেম সম্পর্কে যা আছে তা প্রতিনিয়ত শিখছেন। তিনি ইউরোপের চারপাশে অসংখ্য খেলা দেখেন। সেই সাথে প্রতিপক্ষের সকল খেলোয়াড়দের ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের সেই তথ্যগুলো শেয়ার করেন, যা থেকে খেলোয়াড়রা যথাযথ শিক্ষা নিতে পারে। তিনি প্রশিক্ষণের তত্ত্বাবধান করেন। সেট-পিস রুটিনের দায়িত্ব নেন এবং খেলার নির্দিষ্ট প্যাটার্ন তৈরি করেন।

তবে তার আসল মূল্য তখনই, যখন খেলার নির্দিষ্ট মুহুর্তগুলোতে মাদ্রিদ বিপদে এবং খুব দ্রুত জয়ের পথ নির্ধারণ করার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। প্রতিপক্ষের দুর্বলতা চিহ্নিত করে কীভাবে ম্যাচের গতি পরিবর্তন করতে হয় তা জেনে রিয়ালকে সাম্প্রতিক ইউরোপীয় কিছু উল্লেখযোগ্য ম্যাচে সাফল্য এনে দিয়েছেন ডেভিড।

তবে প্রশ্ন টার্গেট এখন লন্ডনের সেই স্বপ্নের ফাইনাল। যেখানে প্রতিপক্ষ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। প্রতিপক্ষকে বধ করতে বাবার সাথে তৈরি করছেন ম্যাচের পরিকল্পনা। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। হয়তো একদিন বাবার জায়গাও নিয়ে নিবেন। হবেন বিশ্বের কোন সেরা ক্লাবের ম্যানেজার! হয়তো তার বাবা কার্লো আনচেলত্তি মনে মনে এটাই চাইবেন!


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply