শেরপুরের নকলায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ডলি খানম (২২) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে বর্বরোচিত নির্যাতন করা হয়েছে। ওই নির্যাতনে গৃহবধূর গর্ভের সন্তান নষ্টের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার রাতে ওই ঘটনার ভিডিওচিত্র ফাঁস হওয়ায় এলাকায় শুরু হয়েছে তোলপাড়।
ডলি খানম পৌর শহরের কায়দা এলাকার দরিদ্র কৃষক শফিউল্লাহর স্ত্রী ও স্থানীয় চন্দ্রকোনা কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে ঘটনার হোতা নির্যাতিতা গৃহবধূর ভাসুর আবু সালেহসহ জড়িতরা এখনও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এলাকায়।
মামলার বাদী মো. শফিউল্লাহর বড়ভাই মামলার অভিযুক্ত আসামি আবু সালেহের সঙ্গে মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টায় মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি মামলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ওই দিন জমিতে ধান কাটতে গেলে আমার ভাই শফিউল্লাহ ও তার স্ত্রী আমাদেরকে দা দিয়ে ধাওয়া করে। আমরা তা প্রতিরোধ করি। শহিদুল্লাহর স্ত্রী ডলি খানমকে আমার দুই ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ধান ক্ষেতের পাশে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং পরে আমরা পুলিশকে খবর দেই।
আবু সালেহ বলেন, পুলিশ এসে আমাদের থানায় নিয়ে ওই দিনের বিষয়টি আপোষ মীমাংসা করে দেন। এখন আমার ভাই পূর্ব আক্রোশের জের ধরে আমাদেরকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে আমাদের হয়রানি করার চেষ্টা করছে। প্রকৃত পক্ষে আমার ভাই শহিদুল্লাহর স্ত্রী ডলি খানমকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি এবং তার পেটের সন্তান নষ্ট করার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা ডাহা মিথ্যা ও বানোয়াট।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, নকলা পৌর শহরের উপকণ্ঠ কায়দা গ্রামের মৃত হাতেম আলীর ছেলে মো. শফিউল্লাহর সঙ্গে এক খণ্ড জায়গা নিয়ে তার সহোদর বড়ভাই আবু সালেহ (৫২), নেছার উদ্দিন (৪৮) ও সলিম উল্লাহর (৪৪) বিরোধ ও মামলা চলে আসছিল। এর জের ধরে ১০ মে সকালে স্থানীয় গোরস্থান সংলগ্ন শফিউল্লাহর দখলীয় জমির ইরি-বোরো ধান আবু সালেহ ও তার লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে কাটতে গেলে শফিউল্লাহ বাধা দেন।
এতে তিনি প্রতিপক্ষের ধাওয়ার মুখে পিছু হটে নকলা থানায় ছুটে যান। ততক্ষণে আবু সালেহর নেতৃত্বে একদল লোক ধান কাটতে শুরু করে। পরে শফিউল্লাহর ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ডলি খানম ডাক-চিৎকার দিয়ে বাঁধা দিতে গেলে আবু সালেহর হুকুমে তার ছোটভাই সলিমউল্লাহ, ভাইবউ লাখী আক্তারসহ অন্যান্যরা তাকে ঘেরাও করে ফেলে।
এক পর্যায়ে তার চোখে মুখে মরিচের গুড়া ছিটিয়ে দিয়ে তাকে টানা-হেঁচড়া করে পাশের ক্ষেতের আইলের থাকা একটি গাছের সঙ্গে পেছনে হাত রেখে বেঁধে ফেলে। একইসঙ্গে পাশের অন্য গাছের সঙ্গে টানা দিয়ে বেঁধে ফেলে তার ২ পা। এছাড়া তার গোপনাঙ্গসহ পেটে, বুকে, পিঠে উপুর্যপরি কিল-ঘুষি-লাথির আঘাতে তাকে নিস্তেজ করে ফেলে। ওই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে লাখী আক্তার।
এ ঘটনা দেখে শফিউল্লাহকে ওই নির্যাতনের খবর জানাতে ছুটে যায় থানায় এক প্রতিবেশী। পরে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর অবস্থায় ডলি খানমকে উদ্ধার এবং ঘটনায় জড়িত আবু সালেহ ও তার ছোট ভাই বউ লাখী আক্তারকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসার কথা বলে ডলি খানমকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানোর পর প্রভাবশালীদের তদবিরে ছাড়া পেয়ে যান আটক ২ জন।
অন্যদিকে বর্বর নির্যাতনে ডলি খানমের রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং তাকে ১৬ মে পর্যন্ত ৭ দিন চিকিৎসা দেয়ার পরও তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানেও ২২ মে পর্যন্ত ৭ দিন চলে তার চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, নির্যাতনের কারণে ডলি খানমের অকাল গর্ভপাত হয়েছে।
ওই ঘটনায় অসহায় শফিউল্লাহ ৩ জুন শেরপুরের আমলী আদালতে আবু সালেহসহ ৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৫-৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা আমলে নিয়ে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরীফুল ইসলাম খান ভিকটিমের এমসি তলব সাপেক্ষে ঘটনার বিষয়ে তদন্তপূর্বক ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য জামালপুরের পিবিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন।
মঙ্গলবার বিকালে নির্যাতিতা গৃহবধূর স্বামী শফিউল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তার বড়ভাই সেনাসদস্য নেছার উদ্দিনের ইন্ধনে তার স্ত্রী লাখী আক্তার এবং অপর ২ ভাই আবু সালেহ ও সলিমউল্লাহসহ তাদের ভাড়াটে লোকজন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ডলি খানমকে বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে গর্ভের সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া তার প্রভাবেই থানা পুলিশের এসআই ওমর ফারুক মহিলা কনস্টেবলসহ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ডলি খানমকে উদ্ধারের পরও কোন প্রতিকার পাইনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্যাতনের ভিডিওটিও থানাতেই গায়েব করে দেয়া হয়েছে। তবে অনেক চেষ্টায় ঘটনার প্রায় এক মাস পরে হলেও সেই ভিডিওর কিছু অংশ এক প্রতিবেশির কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।
তিনি আরও বলেন, এমন বর্বর নির্যাতনের পরও তারা আজ বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। আর আমি অসহায়। এজন্য আমি ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই।
বিষয়টি সম্পর্কে নকলা থানার ওসি কাজী শাহনেওয়াজ বলেন, জমি-জমার বিষয় নিয়ে ভাই-ভাইদের মধ্যে বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে দুপক্ষকেই শান্ত করা হয়েছিল। গৃহবধূকে নির্যাতনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে জামালপুর পিবিআইয়ের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সীমা রাণী সরকার বলেন, আদালতের কাগজপত্র এখনো হাতে পাইনি। পেলে অবশ্যই দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a reply