চট্টগ্রামের পাড়া-মহল্লায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। নগরীর ৩শ’ স্পটে অন্তত ৫৫০ জন কিশোর অপরাধীর বিচরণ। নগরীর এই স্পটগুলোতেই ওদের আড্ডা বসে নিয়মিত।
তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মোবাইল, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা ইস্যুতে সামান্য মতানৈক্য হলেই এদের মাথায় খুন চেপে বসে।
কিশোররা প্রকাশ্যেই জড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী সংঘাত-হানাহানিতে। বিত্তশালী পরিবারের এই আদুরে সন্তানদের নানামুখী অপরাধমূলক কার্যক্রম ভাবিয়ে তুলেছে চট্টগ্রামের সচেতন মহলকে।
গত দেড় বছরে কিশোর অপরাধে নগরীর বিভিন্ন থানায় অন্তত ২৫টির বেশি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ ছিনতাই মামলার বেশিরভাগ আসামিই কিশোর।
ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এসব কিশোর গ্যাংকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে কিছু ‘বড়ভাই’ নামধারী রাজনৈতিক নেতা। যাদের ছত্রছায়ায় এসব কিশোর অপরাধী দিন দিন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুহম্মদ সিকান্দার খান বলেন, এখন অপরাধ করার জন্য যা প্রয়োজন, তা সহজেই কিশোররা পেয়ে যাচ্ছে।
একশ্রেণির লোক কিশোরদের অপরাধে সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। তা দিয়ে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বয়সে যারা কিশোর তাদের সব সময় ভিন্ন কিছুর দিকে মনোযোগ থাকে বেশি। এ জন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. অনুপম সেন বলেন, ছেলেরা স্কুল-কলেজে ঠিকমতো যাচ্ছে কি না, স্কুল ছুটির পর তারা কোথায় যাচ্ছে, তা অভিভাবকদের নজরে রাখতে হবে। তা না হলে কিশোর ছেলেটা অসৎ লোকদের সংস্পর্শে খারাপ হয়ে যাবে।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ খুনের জন্য সাব্বির নামে এক কিশোরকে দায়ী করা হয়। ওই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। পরে নগর পুলিশ অপরাধ চক্রে জড়িত কিশোর এবং অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা তৈরি করে। তালিকায় প্রায় ৫৫০ জন কিশোর অপরাধীর নাম চলে আসে।
অপরাধপ্রবণ স্পটের নামের তালিকাও দীর্ঘ হয়। বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে তৈরি স্পটের সংখ্যা ৩০০-তে গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ এসব স্পটে কিশোর অপরাধীরা আড্ডা বসায়। সন্ধ্যার পর এসব স্পটে আড্ডায় দেখা গেলে কিশোর-তরুণদের আটকের ঘোষণাও দেয়া হয় নগর পুলিশের পক্ষ থেকে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, গত দেড় বছরে কিশোর অপরাধের ঘটনায় নগরীর ১৬টি থানায় অন্তত ২৫টি মামলা হয়েছে।
মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৫০ জনের বেশি কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সবশেষ ১৮ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় কিশোর অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে কোন্দলের জেরে খুন হয়েছে এক কিশোর। গত দু’মাসে এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার পর চট্টগ্রাম নগরীতে ‘কিশোর গ্যাং’ আবারও আলোচনায় আসছে।
টিআইবি, চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘এক শ্রেণির দুষ্ট ‘বড়ভাই’য়ের উৎসাহে স্কুল-কলেজপড়–য়া কিশোররা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
প্রায়ই দেখা যায়, অপরাধের কারণে কিশোরের শাস্তি হলেও পর্দার আড়ালে থাকা সেই দুষ্ট বড়ভাইয়েরা সহজে আইনের আওতায় আসে না। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সতর্ক থাকতে হবে। কিশোর অপরাধীদের পাশাপাশি পর্দার আড়ালে থাকা বড়ভাইদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার জেরে কিশোরদের দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ দ্বন্দ্বের জেরে নগরীর গোলপাহাড় এলাকার যুবলীগ কর্মী এমএইচ লোকমান রনি নিহত হন স্থানীয় সন্ত্রাসী সাইফুল ইসলামের গুলিতে। এর দু’দিন পর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সাইফুল।
গত ১০ মে নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর পিলখানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ছুরিকাঘাতে খুন হন মোস্তাক আহমেদ (৩৫)।
ছেলের সঙ্গে বখাটে কিশোরদের ঝগড়া মেটাতে গেলে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনায় জড়িত ১০-১৫ জনের সবার বয়স ১৮ বছরের কম।
১৪ মে নগরী ডবলমুরিং থানার হাজিপাড়ায় রিকশাচালক রাজু আহমেদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় ১০-১২ জনের কিশোর।
জানা যায়, তাদের ‘বড়ভাই’ ছগির হোসেন জেল থেকে নির্দেশ দেন মফিজ নামের একজনকে খুন করার জন্য। কিন্তু টার্গেট মিস করে কিশোররা রাজুকে খুন করে ফেলে। পুলিশ পরে ওই গ্রুপের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করে, এদের সবার বয়স ১৮ বছরের মধ্যে।
১৪ এপ্রিল ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুন করে তার ছেলে রবিন বড়ুয়া। কোতোয়ালি থানার কাজির দেউড়ীর ব্যাটারি গলিতে এ ঘটনা ঘটে। বাবার ঘাতক এই কিশোরের বয়সও ১৮ বছরের নিচে।
২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসার সামনে খুন হন নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ ঘটনায় জড়িত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
এর মধ্যে তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই কিশোর। চট্টগ্রামে দিন দিন কিশোর অপরাধী গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া স্কুল-কলেজপড়ুয়া এসব কিশোরের বেশিরভাগই অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী ঘরের বখে যাওয়া সন্তান।
সিএমপির কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, খুন, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ সব ধরনের অপরাধেই কিশোর অপরাধীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে।
দিন দিন কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ যেন বাড়ছেই। শুধু আইনের প্রয়োগ দিয়ে কিশোরদের অপরাধ থেকে দূরে সরানো যাবে না। এ জন্য পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে।
সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে- অভিভাবকদের সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে, ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষকে যে যার অবস্থান থেকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে কিশোরকে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে না দিই।
কথা হয় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) এসএম মোস্তাইন হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, কিশোর অপরাধীদের ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক আছে। শুধু পুলিশি অ্যাকশন দিয়ে এ ধরনের সামাজিক অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ জন্য অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা রাখতে হবে।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply