বিশ্বকাপ ছাড়াই কি মেসি সর্বকালের সেরা?

|

ছবি: সংগৃহীত

কাতার বিশ্বকাপে অবিস্মরণীয় ফুটবল খেলে নিজের অবিশ্বাস্য ফুটবল পরিসংখ্যানকে আরও একবার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। অথচ ২০১৬ সালে মেটলাইফ স্টেডিয়ামের পরিবেশ এমন ছিল না। চিলির বিপক্ষে কোপা আমেরিকার ফাইনালে টাইব্রেকারে প্রথম পেনাল্টি মিস করেন মেসি। ফাইনালও হেরে যায় আর্জেন্টিনা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সেটা ফাইনালে মেসির তৃতীয় হার।

তারপর ভুলে যাওয়ার মতো এক সময় কেটেছে মেসির। সার্জিও আগুয়েরো বলেছেন, তার বন্ধুকে কখনোই এতটা ভেঙে পড়তে দেখেননি তিনি। মেসি জানতেন, সর্বশেষ এই ব্যর্থতাকেই সবাই মনে রাখবে। সবাই ভাববে, আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে খেলতে পারেন না এই ক্ষুদে জাদুকর। দিয়েগো ম্যারাডোনার মতো প্রিয় আর্জেন্টাইনদের কাছে কখনোই হতে পারবেন না তিনি। কেবল বার্সেলোনার হয়েই ভালো, আর আর্জেন্টিনার হয়ে অচেনা- এমন অপবাদের পেছনে প্রমাণও তখন হাতের কাছেই।

আর এমন মুহূর্তেই বিষাদ গ্রাস করলো মেসিকে। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বিদায়ের কঠিনতম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন তিনি। বলে দেন, আর্জেন্টিনার জার্সিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এবারও হলো না। আমি পারিনি। মনে হচ্ছে, অবসর নিয়ে ফেলাই ভালো। আমার জন্য, সবার জন্য, আর যারা এমনটা চায় তাদের সবার জন্যই ভালো হবে এই সিদ্ধান্ত।

কিন্তু মেসির বিদায় যে চায়নি খোদ আর্জেন্টাইনরাই! এমনকি কোপা বিজয়ী চিলির আর্জেন্টাইন কোচ হুয়ান আন্তোনিও পিজ্জিও আঁতকে ওঠেন মেসির এই ঘোষণায়। বলেন, মেসির পরিসংখ্যান গোটা বিশ্বের কারও সাথেই মেলে না। এই রেকর্ড কেবল মেসিরই। আমার মনে হয়, এমনটাই থেকে যাবে। কারণ, মেসি যা করেছে তা ফুটবলে অন্য কারো পক্ষে করাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আমাদের জেনারেশন মেসির সাথে ম্যারাডোনার তুলনা দেখতে চায় না। কারণ, ম্যারাডোনা তখন যা করেছিল তা সব সময়ই মনে থাকবে। কিন্তু আমার মনে হয়, সর্বকালের সেরা ফুটবলার আজ এখানে খেলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মেটলাইফে।

অবধারিতভাবেই, ক্যাপ্টেন মেসিকে জাতীয় দলের জার্সিতে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করতে শুরু হলো ক্যাম্পেইন, যাতে যোগ দিয়েছিলেন খোদ আর্জেন্টাইন ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিসিও ম্যাক্রি। জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনিও মেসিকে বলেন থেকে যেতে।

সে সময় ১৫ বছর বয়সী এক বালক লেখেন মেসির উদ্দেশে এক খোলা চিঠি। সেখানে তিনি বলেন, মেসি, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। কেবল থেকে যাও। আশা করি, আনন্দ ধরা দেবে। চাপে বিপর্যস্ত এই পৃথিবীতে খেলার মাঝেও অনেক আনন্দ খুঁজে পাওয়াত সম্ভব। আকাশি-সাদা জার্সিতে তোমাকে খেলতে দেখাই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বড় গর্বের জায়গা। আনন্দের জন্য খেলো। কারণ তুমি জানো না, বল নিয়ে আনন্দ করছে মেসি, এটা দেখা দুনিয়া জোড়া অগণিত মানুষের কাছে কতটা খুশির ব্যাপার।

রোববার (১৮ ডিসেম্বর) লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে মেসির সাথে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে নামবে এনজো ফার্নান্দেজ; ২০১৬ সালে যার বয়স ছিল ১৫। চিঠির লেখককে এবার চিনতে পারছেন?

মাঝের এই সময়ে ঘটে গেছে অনেক কিছুই। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপেও ব্যর্থতা সঙ্গী হয়েছে মেসির। তারপরই আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্বে আসেন লিওনেল স্কালোনি; যাকে নিয়ে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ও তো বুয়েনস আইরেসের মোড়ে ট্রাফিকও সামলাতে পারবে না!

তবে জাতোয় দলের জার্সিতে পারলেন স্কালোনি। কেবল কৌশলগত পরিবর্তনই নয়, ক্লাবের মতো পরিবেশ ও স্পিরিট তিনি নিয়ে আসেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের ক্যাম্পে। আর তারই ধারাবাহিকতায়, মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপে আমেরিকার শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা।এই জয় মেসির বুক থেকে নামিয়ে দেয় এক পর্বতপ্রমাণ বোঝা। জাতীয় দলে খেলা আবারও আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মেসির জন্য।

এরপর লা ফিনালিসিমায় ইতালিকে উড়িয়ে দেয় আলবিসেলেস্তেরা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতার বিশ্বকাপে যায় মেসির আর্জেন্টিনা। অবিশ্বাস্য পারফরমেন্স দিয়ে আবারও দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালের তুলেছেন লিওনেল মেসি। লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে ফাইনালের আগে মেসি বলেন, গত কয়েক বছরে জাতীয় দলের হয়ে খেলা সত্যিই খুব উপভোগ করছি। কোপা আমেরিকা জয়, টানা অপরাজিত থাকার যাত্রা, আর ফাইনালের মাধ্যমে এই যাত্রার ইতি টানা- সবই অবিশ্বাস্য। আশা করি, আর্জেন্টাইনরা আমাদের খেলা উপভোগ করছে। আমাদের চেষ্টা ও নিবেদন নিয়ে হয়তো আর কারো সন্দেহ থাকা উচিৎ হবে না।

সত্যিই এখন মেসি মাঠে নিজের সবটাই দিচ্ছেন। আর মাঠে এতটা সময় যিনি কেবলই হাঁটেন, তার থেকে এমন পারফরমেন্স পাওয়া রীতিমতো বিস্ময়কর। হোর্হে ভালদানোর মতে, সময় ও বয়স হয়তো মেসির গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। তবে এই সময়ে আরও বেশি বিচক্ষণ হয়ে উঠেছেন এই ফুটবল জাদুকর। মেসিরই সাবেক সতীর্থ পাবলো জাবালেতার মতে, মাঠে রেগেও যাচ্ছেন মেসি। সৌদি আরবের সাথে হেরে যাওয়ার পর ড্রেসিংরুমে ‘রাগান্বিত’ মেসির কথাই উদ্দীপ্ত করে সতীর্থদের।

জয় লাগবেই, এমন সমীকরণ সামনে রেখে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচে অসাধারণ এক গোলে আর্জেন্টিনার আশা ফিরিয়ে আনেন মেসি। এরপর আর পেছন ফিতে তাকাতেই হয়নি আলবিসেলেস্তেদের। এই আসরের আগে বিশ্বকাপের নকআউটে কোনো গোল ছিল না এই ফুটবল জাদুকরের? আর এখন তার আছে তিনটি নকআউট গোল। সেই সাথে আছে দুইটি অ্যাসিস্ট, যে দুই অ্যাসিস্ট অনায়াসে জায়গা করে নেবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বসেরা অ্যাসিস্টের তালিকায়।

সর্বকালের সেরা হিসেবে মেসিকে মেনে নিতে এবার সত্যিই হিমিশিম খেয়ে যাচ্ছেন তার সমালোচকরা। তাদের একমাত্র ইস্যু এখন মেসির ক্যাবিনেটে বিশ্বকাপ ট্রফির অনুপস্থিতি। তবে এই অভাব ঘুচে যেতে পারে লুসাইলের ফাইনালেই। তবে সেই ফলাফল ছাড়াই, ইতিহাসের সুন্দরতম ফুটবলার হিসেবে মেসি থেকে যাবেন অক্ষয়, অক্ষত। সেদিক থেকে বহুল আলোচিত বিতর্কের শেষ এখনই বলে দেয়া যেতে পারে। কোনো খেলোয়াড়ই নয়, পেলে কিংবা ম্যারাডোনাও নয়। ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন অবিশ্বাস্য ফুটবল ধারাবাহিকভাবে খেলে যাওয়া একমাত্র ফুটবলারই লিওনেল মেসি।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর মেসির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কিলিয়ান এমবাপ্পের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে মেসির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমকক্ষতা অর্জন করতে যে দশকব্যাপী একই হারে খেলে যেতে হবে এমবাপ্পেকে! তার পরেই না আসবে তুলনা!

লিওনেল স্কালোনি আগে ভেবেছিলেন, কেবল আর্জেন্টাইনরাই হয়তো মেসির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছে। তবে এরপর তিনি দেখলেন, মেসির প্রতিপক্ষও বলছে, এই ফুটবল জাদুকরের সাথে একই মাঠে খেলাও তাদের কাছে অনন্য সম্মানের। আরেক এলএমটেন লুকা মদ্রিচ স্বীকার করে নিয়েছেন মেসির শ্রেষ্ঠত্ব। অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার কিয়ানু বাচুস বলেন, মেসিকে মাঠে দেখে ঠিক বিশ্বাস হয় না! সে সত্যিকার অর্থেই এতটা ভালো যে, চোখে দেখেও অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে যেন এক মোমের ভাস্কর্য!

আর বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাসিস্ট মেসি করেছেন চলতি আসরের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ক্রোয়েশিয়ার জস্কো গার্দিওলকে ঘোল খাইয়ে। সেই গার্দিওলের কথাটা এমন, আজ নাহয় কাল আমি আমার শিশুদের বলতে পারবো, মেসিকে আমি ৯০ মিনিট মার্ক করেছি।

অন্যদিকে, যে ফ্রান্স এখন মেসি ও আর্জেন্টিনার সাথে বিশ্বকাপ ট্রফির একমাত্র বাধা, সেই দলের কোচ দিদিয়ের দেশম জানিয়েছে, তার দেশের অনেক মানুষও মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখতে চায়। এমনকি ব্রাজিলিয়ান অনেকেও এখন প্রার্থনা করছে মেসির জন্য। তেমন ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়তো রোনালদো নাজারিও। তিনি জানিয়েছেন, মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি উঠলেই খুশি হবেন তিনি। আর রিভালদোর মত, মেসিই এখন বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় দাবিদার। বলেছেন, মেসি, মানুষ হিসেবে তুমি যতটা চমৎকার এবং মাঠে যা করে আসছো, তাতে এই বিশ্বকাপ তোমারই প্রাপ্য। ঈশ্বর সবই জানেন। রোববার তোমার মাথায় রাজমুকুট তিনিই তুলে দেবেন।

মেসি এরই মধ্যে ফুটবলের রাজা। তার পরিসংখ্যান ও প্রভাব রীতিমত একক ও অবিশ্বাস্য। ৩৫ বছর বয়সে এবারও গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বলের অন্যতম দাবিদার মেসি। মেসি তাই ট্রফি সর্বস্ব নয়; তার সাথে মিশে থাকে প্রতিভা, বিস্ময়, জাদুবাস্তবতা ও দুনিয়াজোড়া সীমাহীন আবেগ। অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে আর্জেন্টাইনদের বিশ্বজয়ের স্পৃহার প্রতীক এই বাম পায়ের জাদুকর। মেসিকে বলা সাংবাদিক সোফি মার্টিনেজের কথা যেন লাখো মানুষের প্রতিধ্বনি, ফলাফল যাই হোক, কিছু বিষয় কেউই তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, মেসি। তোমার মাঝেই অনুরণিত হয় সকল আর্জেন্টাইনদের স্বপ্ন। এমন কোনো শিশু নেই যার গায়ে তোমার জার্সি শোভা পায় না। আসল হোক, নকল হোক, প্লাস্টিক কেটে বানানো হোক। সত্যিই, তুমি তোমার চিহ্ন এঁকেছো আমাদের সবার জীবনে। অগণিত মানুষের জীবনে এত এত আনন্দ নিয়ে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, মেসি।

তবে আর্জেন্টিনার জন্য কেবল আনন্দ এবং উত্তেজনার উত্সই নয় মেসি। দেশটির ফুটবলে রেনেসাঁ ঘটানোর এই মহানায়ককে প্রত্যক্ষ করাই যে অনন্য সুন্দর এক বিশেষ অভিজ্ঞতা! সেই অর্থে, ট্যাঙ্গোর সুরে সঙ্গীত বন্ধ হয়ে গেলে কী ঘটে তা সত্যিই হয়তো বিবেচ্য নয় অনেকের কাছে। পৃথিবী এরইমধ্যে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে মেসির ‘দ্য লাস্ট ডান্স’। আর বিশ্বকাপের ফাইনালে যেই জিতুক না কেন, লুসাইলের ভাগ্যবান প্রতিটি মানুষই বলতে পারবে, এখানেই মাঠে ফুল ফুটিয়ে গেছেন পৃথিবীর সুন্দরতম ফুটবলার।

/এম ই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply