মহেশখালীতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা: বিএনপি নেতাকে হত্যা, ব্যাংকে চাঁদা দাবি

|

সারাদেশ ডেস্ক:

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাকে হত্যা, ইউনিয়ন পরিষদে লুটপাট ও ভাঙচুর, ব্যাংকে চাঁদা দাবি, জেলার প্রথম শহীদ পরিবারসহ অন্তত ৩০টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর এবং চিংড়ি ঘেরে মাছ চুরির ঘটনা ঘটেছে।

বিএনপি নেতাকে হত্যা:

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দিনই বিজয় মিছিল করে মহেশখালী উপজেলা বিএনপি। মিছিল শেষে দলটির উপজেলা কার্যালয়ে কাজ শেষে ফেরার পথে হামলার শিকার হন মহেশখালী বিএনপির দফতর সম্পাদক ও শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম।

ওইদিন পৌরসভার বানিয়ার দোকানের সামনে এলে তাকে পথরোধ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় শফিউল আলমকে বেড়ধক মারধর করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ আগস্ট তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর পরই মহেশখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবু বক্কর সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, সাবেক এমপি আলমগীর ফরিদের নির্দেশে তার ভাতিজা নাহিদের (উপজেলা যুবদলের যুগ্ন আহবায়ক) নিজের অফিসের সামনে লোকবল নিয়ে শফির ওপর হামলা চালায়। শফিউল আলম শফির পরিবারও একই দাবি করেছে।

পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে ১৩ আগস্ট রাতে আলমগীর ফরিদ দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

প্রতক্ষ্যদর্শী সূত্রে জানা যায়, দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে ৫ আগস্ট আনুমানিক রাত ১১টার পর বাড়িতে ফেরার পথে বিএনপি নেতা শফির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। উপজেলা যুবদলের যুগ্ন আহ্বায়ক জাহেদুক হকের নেতৃত্বে তার ওপর হামলা করে আনুমানিক ২০ জনের একটি দল। শফিকে মারধরে তারা উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনচার উল্লাহ, ছাত্রদলের আহ্বায়ক তারেক রহমানকে জুয়েলকে দেখতে পান।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফি তার ওপর হামলার বিষয়ে বিবরণ দিয়ে গেছেন। তাতে তিনি বলেন, নাহিদের নেতৃত্বেই তার ওপর হামলা হয়।

নিহত বিএনপি নেতা শফিউল আলম শফি।

এ ঘটনার বিষয়ে কক্সবাজার জেলা বিএনপির দফতর সম্পাদক ইউসুফ বদরী বলেছেন, শফিউল আলম শফির হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি। ইতোমধ্যে এ নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতে কেউ আইন বহিভূর্ত কাজ করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ব্যাংকে চাঁদা দাবি:

মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নে ওসমান গণি কমপ্লেক্সে ইউনিয়ন ব্যাংকের উপশাখায় গিয়ে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। ১১ আগস্ট স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজমুল হোসাইন ছিদ্দিকী ব্যাংকে গিয়ে চাঁদা দাবি করেন। এ ঘটনায় ভবনের মালিক পক্ষের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে বদরখালী শাখার ব্যবস্থাপক মো. হাসান শহীদ সরওয়ার উদ্দীন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইস্যু করেছে। উল্লেখ্য, বদরখালী শাখার অধীনে ইউনিয়ন ব্যাংকের কালারমারছড়া শাখা পরিচালিত হয়।

ইউনিয়ন পরিষদে ভাঙচুর ও লুটপাট:

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদে লুটপাট করে ভাঙচুর চালায় সন্ত্রাসীরা। এরপর একাধিক রাতে ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় তারা।

এ বিষয়ে কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ বলেছেন, জিয়া ও বাবর বাহিনীর নেতৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদে লুটপাট ও হামলা চালানো হয়। গ্রাম আদালতে বিচারাধীন সালিশের জমা প্রায় ২০ লাখ টাকা, ১০০ বস্তা চাল, ডিজিটাল সেন্টারের কম্পিউটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় তারা।

শহীদ পরিবারসহ ৩০ বাড়িঘর ও রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর:

৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার জেলার প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফের পরিবারে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নে মোহাম্মদ শরীফের সন্তান ও নাতিদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে স্বর্ণ, নগদ টাকা ও বাড়ির আসবাবপত্র লুট করে। ওইদিন রাতেই শহীদ পরিবারের সন্তান, নাতি ও তাদের আত্মীয়সহ মোট ১৯টি বাড়িতে লুটপাট চালানো হয়। সব বাড়িতেই অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর বিভিন্ন দিনে আরও বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া, কালারমারছাড়ায় একাধিক চিংড়ি ঘেরে নিয়মিত মাছ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একইদিন রাতের অন্ধকারে মহেশখালী পৌরসভায় বাটারফ্লাই নামের একটি রেস্টুরেন্ট আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হোয়ানক ইউনিয়নে সাবেক ছাত্রদল নেতা রেজাউল করিমের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা।

আরও পড়ুন: কক্সবাজারে ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলার প্রথম শহীদ পরিবারসহ ১৯ বাড়িতে লুটপাট ও আগুন

কালারমারছড়ায় ভাঙচুর, লুটপাট ও ব্যাংকে চাঁদাবাজির নেপথ্যে:

কালারমারছড়া ইউনিয়নে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে একটি হলো শরীফ পরিবার, অপরটি মাতব্বর পরিবার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই দ্বন্দ্ব বেশ বেড়ে যায়। মাতব্বর পরিবারের জিয়াউর রহমান ও মিজানুর রহমানকে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন তৎকালীন এমপি আলমগীর ফরিদ। ওই সময় শরীফ পরিবার এলাকা ছাড়া হয়। তাদের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

বিএনপির শাসনামলে কালারমারছড়ায় নিয়মিত সন্ত্রাসী কার্মকাণ্ড চলতো। এরপর এক-এগারোর সময় এলাকায় ফিরে শরীফ পরিবার। এলাকায় অবস্থান করা নিয়ে তখন দুই পরিবারের মধ্যে সংঘাত লেগেই থাকতো। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৯-এ উপজেলা ও ২০১১-এ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেন সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গণি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে জেলার প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফের পুত্র। ভোট করার কারণে দুই পক্ষকে তিনি এলাকায় শান্তিতে সহাবস্থানের আহ্বান জানান। এরমধ্যে ২০১২ সালের মার্চে নিজ অফিসে ওসমান গণিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে মাতব্বর পরিবারের জিয়া বাহিনীর জিয়া ও তৎকালীন চেয়ারম্যান মীর কাশেমকে মূল হোতা হিসেবে দাবি করে মামলার বাদী হোছাইন মোহাম্মদ আল নোমান শরীফ।

ওসমান হত্যাকাণ্ডের পরপরই তার লোকজন মাতব্বর পরিবারের অনেকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। হত্যাকাণ্ড ও ঘরবাড়ি ভাঙচুরের দুইটি ঘটনাই মামলা হয়। এর মধ্যে ওসমান চেয়ারম্যান হত্যা মামলা চলমান। আর ঘরবাড়িতে ভাঙচুরের মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

ওসমান হত্যাকাণ্ডের পরপরই আসামিরা পলাতক হয়। এই হত্যা মামলাসহ আরও বিভিন্ন মামলায় কেউ কেউ জেল কেটেছে দীর্ঘদিন। মাতাব্বর পরিবারের সদস্যরা কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজ গ্রামে ফিরেননি। কেউ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে আবার কেউ কালারমারছড়ার উত্তর প্রান্তে থাকেন।

এর মধ্যে ২০১৭ সালে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হন ওসমান গনির ছেলে তারেক বিন ওসমান শরীফ। তখন শরীফ পরিবারের বিরোধীরা (সাবেক চেয়ারম্যান মীর কাশেম, মাতব্বর ও অন্যান্য) তারেককে ঠেকাতে নৌকার পক্ষে কাজ করে। মীর কাশেম তখন ইউপি চেয়ারম্যান থাকলেও সেবার ভোটে অংশ নেননি। ২০২২ সালে আবারও চেয়ারম্যান হন তারেক, ওইবার তার মার্কা ছিল নৌকা। পরে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।

অন্যদিকে, আলমগীর ফরিদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মাতব্বর পরিবারের জিয়াউর রহমান ও মিজানুর রহমান ২০১১ পরবর্তী বিএনপির কোনো কমিটিতে স্থান পায়নি। মহেশখালীতে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের কমিটিতে তখন থেকেই আলমগীর ফরিদের অনুসারীরা কোণঠাসা। মাতব্বর পরিবারের আরেক সন্তান স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজমুল হোসাইন ছিদ্দিকী ফরিদ মিয়া আরমানের অনুসারী। বিএনপিতে এখন কোনো পদে নেই এ দুই গুরু-শিষ্য।

মাতব্বর পরিবারের একাধিক সদস্যের অভিযোগ, ২০১২ সালের পর (ওসমান হত্যাকাণ্ড) তাদেরকে এলাকায় আসতে দেয়া হয়নি। এ সময় তাদের সম্পদ ভোগ করেছে তারেক।

তারেক চেয়ারম্যান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। উল্টো তার অভিযোগ, শরীফ পরিবারের অনেককে হত্যায় জড়িত মাতব্বর পরিবার। নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য তারা গা ঢাকা দিয়েছিল। তারা এলাকায় সন্ত্রাসী উত্তপ্ত করতে চায় তারা, আমাদের আত্মীয়-স্বজন পেলেই মেরে আহত করছে। আমাদের দোকানে গিয়েও চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। আর বিএনপি সরকারের আমলে জিয়া বাহিনীর লোকজন আমাদের সব সম্পদ ভোগ করেছে।

এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই শরীফ পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব সাবেক চেয়ারম্যান মীর কাশেমের পরিবারের। ’৭১-এ শহীদ মুহাম্মদ শরীফকে হত্যায় অভিযুক্ত ছিলেন মীর কাশেমের পিতা। মীর কাশেমের পরিবার শরীফ পরিবারকে হটাতে মাতব্বর পরিবারকে সহযোগিতা করে।

কালারমারছড়ায় হামলা-ভাঙচুরের বিষয়ে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী জানিয়েছেন, হামলার বিষয়টি তিনি জেনেছেন। মহেশখালীতে নিয়োজিত নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্টকে তিনি হামলার বিষয়টি জানিয়েছেন।

এদিকে, কালারমারছড়ার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, তারা যেন এলাকায় শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করার তাগিদ দেন তারা।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply