ইব্রাহিম খলিল
ঢাকার মুগ্ধচিত্র মনে আসলে সদরঘাটের ব্যস্ত ছবিটি ভেসে উঠতে বাধ্য। কিছুদিন আগে আয়নাবাজি ছবিতে সূর্যের প্রবঞ্চক খেলায় সারি নৌকা ছেয়ে থাকা সদরঘাটের অপরূপ দৃশ্য দর্শক দেখতে পায়। সদরঘাটের ছোট নৌকার সারির মনোরম দৃশ্য উঠে আসে নামি-দামি স্থির চিত্রে। তবে সদরঘাটের এই মনোরম নৌকা দৃশ্যের অপর পিঠে রয়েছে প্রাণঘাতী আরেক ভয়ঙ্কর ছবি।
গেল ০৭ মার্চ রাতে সুরভি নামে একটি লঞ্চের ধাক্কায় এমনই একটি ছোট্ট নৌকা ডুবে যায়। যেখানে পরিবারের প্রধান শাহজালাল আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও তলিয়ে যায় তার পরিবারের অন্য ছয় সদস্য। নিখোঁজ সদস্যরা হলেন শাহজালালের স্ত্রী শাহিদা এবং তাদের দুই ছোট্ট মেয়ে মীম ও মাহি। শাহজালালের ভাই দেলোয়ার, তার স্ত্রী জামশিদা ও তাদের ৭ মাস বয়সী শিশু সন্তান। পরবর্তী দুই দিনে একে একে ভেসে উঠছে লাশগুলো। করা হচ্ছে উদ্ধার। এমন পরিস্থিতির পর সব হারানো শাহজালালের মনের অবস্থা পৃথিবীর কোন অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করা যাবে না।
তবে আশ্চর্য বিষয়, লঞ্চ স্টিমারে ধাক্কা লেগে সদরঘাটে এমন ছোট নৌকা ডুবে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অহরহই ঘটে। মৃত্যুর হার বেশি হলে মিডিয়া কাভারেজ পায়। ফলাও করে উদ্ধার অভিযানের সংবাদ প্রচার হয়৷ মৃতরা উদ্ধার হয়ে গেলে সেই দৃশ্যপট আবার মুছে যায়। সবাই ভুলে যায়। সদরঘাট তার অনিয়মের অভ্যস্ত নিয়মে প্রতিদিনের মত আবার চলতে থাকে। এই নিখোঁজ অভিযানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি বিষয় আমার দাগকেটে উপলব্ধি হলো যে, একই রুটে বড় বড় জাহাজ, যাত্রীবাহী লঞ্চ, বড় বালুবাহি স্টিমার-বাল্কহেড চলাচল করে আবার সেই নৌপথেই দিনে-রাতে ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকাগুলো যাত্রী ভর্তি করে বুড়িগঙ্গার এপার ওপার হয়। এমন জীবনঝুঁকির দৃশ্য পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা। আমার জানা নেই। কেমন করে প্রতিনিয়ত এত প্রাণ ডুবে যাবার পরও আমাদের বোধের দরজায় কড়া নাড়ে না। নাকি দায়িত্বরতদের বোধ তলানিতে, প্রশ্ন জাগে।
হরহামেশাই সদরঘাটে লঞ্চ স্টিমারে ধাক্কা লেগে নৌকাডুবে মানুষ মরে গেলেও, অবৈধভাবে এমন ঝুঁকি নিয়ে বুড়িগঙ্গার নৌকা পারাপার বন্ধ করা গেছে? যায়নি। বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেই দায়িত্বশীলরা বলেন, সদরঘাটে থেকে ছোট নৌকায় বুড়িগঙ্গার এপার ওপার হবার ব্যবস্থা বন্ধ করা হবে দ্রুত। আদতে তা কই ঘটে। এও শোনা যায়, নৌকা মালিক আর প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে এই প্রাণঝুঁকির পারাপার নাকি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সদরঘাটে জাহাজ লঞ্চ স্টিমারে রুটে যদি দ্রুত এই ছোট নৌকায় বুড়িগঙ্গা পারাপার বন্ধ করা না যায়। তবে এমন প্রাণডুবি আরো আরো ঘটবে। সুতরাং অবিলম্বে পারপারে ছোট নৌকা বন্ধ করে বিকল্প পারাপারের ব্যবস্থা, টানেল নির্মাণ কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে আবার প্রশ্ন জাগবে, কতটা প্রাণ ডুবলে বিবেকের দরজায় কড়া নাড়া যায়।
লেখা শেষ করবো সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কবিতা “ষোল আনাই মিছে” দিয়ে। মুগ্ধকর কবিতাটির শেষ চার লাইনে লেখা- মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু, মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু? বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!” তাই অভিভাবকদের বলবো আপনার সন্তানদের জরুরি ভিত্তিতে সাতার শেখান। সাতার কতটা প্রয়োজনীয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন যখন নৌ ভ্রমণে থাকবেন আর মাঝনদীতে ঝড় উঠবে। আতঙ্ক আর আফসোসে তখন হাত কামড়ালেও লাভ হবে না। যদিও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বুড়িগঙ্গার বিষকালো জলে ভালো সাতার জানা লোকটিও ভিমড়ি খেতে বাধ্য।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
Leave a reply