অভিজ্ঞতা থেকে: চীন কীভাবে মহামারি করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করেছে

|

দ্বীন মুহাম্মদ প্রিয়:

চীন কীভাবে এই মহামারি করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারলো আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটু তুলে ধরতে চাই।

১. এই ভাইরাসটি যখন উহানে ছড়িয়ে পড়লো তখন চীনের উহান শহরের সরকার তথা হুবেই প্রদেশের সরকার তেমন পাত্তা দেয়নি কিন্তু পরবর্তীতে এই ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করে। সাথে সাথে চীনের কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি শি জিং পিং হুবেই প্রদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারিকে প্রত্যাহার করেন এবং ১০০ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেন তাদের ব্যর্থতার জন্য। নতুন সেক্রেটারি নিয়োগ দেওয়া হয় এবং কাজের ক্ষেত্রে ১০ গুন বেশি গতি আসে।

২. মহামারি প্রতিরোধ কমিটি করা হয় এবং সেই কমিটির প্রধান নির্বাচিত করা হয় চীনের প্রধানমন্ত্রীকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীকে উহানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং। তিনি সম্পূর্ণ চীনে প্রতিটি জায়গায় মহামারি প্রতিরোধ কমিটি করে দিয়েছিলেন এবং সেই কমিটির প্রতিদিন সকল তথ্য দিতে হয়েছে। কেউ না দিতে পারলে তাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিটি সিদ্ধান্ত তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে সেই কমিটি।

৩. সর্বশক্তি দিয়ে ২ মাস হুবেই প্রদেশ, হুনান প্রদেশ এবং আরো অনেকগুলো প্রদেশ এবং শহর লকডাউন করে রেখেছিল চীন। সম্পূর্ণ চীনে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল। ২ মাস কেউ বাইরে যেতে পারেনি। যদি কেউ বাইরে যেতো তাকে গ্রেফতার করা হতো। ২ মাস কোনো ধরনের বাস, ট্যাক্সি, ট্রেন, বিমান চলেনি।

৪. চীন সরকার হুবেই প্রদেশে কত বিলিয়ন ইউয়েন (চাইনিজ টাকা) পাঠিয়েছে আমি তার একটি ছবি দিয়ে দিয়েছি। এত বিলিয়ন ইউয়েন খরচ হয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তারপরে কত বিলিয়ন লেগেছে সেটার হিসাব এখনো পাইনি। এতগুলো টাকার সঠিক ব্যবহার করা হয়েছে সেই জন্যই চীন এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে পেরেছে।

৫. চীন সরকার পুরো হুবেই প্রদেশ এবং অনেকগুলো প্রদেশ যে প্রদেশগুলো আমাদের দেশের আয়তনের চাইতে বড় সেই প্রদেশগুলোকে ডিসইনফেক্ট (জীবানুমুক্ত) করেছে। রাত নয়টা থেকে জীবাণু মুক্ত করা শুরু হয়েছে এবং সেটি আমাদের তিন দিন আগে থেকে অবহিত করা হতো যে রাত নয়টা থেকে জীবাণুমুক্ত করা শুরু হবে আমরা যেন আমাদের রুমের জানালাগুলো বন্ধ করে রাখি কারণ যে মেডিসিনটা দিয়ে জীবানু মুক্ত করা হবে সেটি মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর।

৬. চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভীষণ উন্নত। এখানে প্রতিটা হাসপাতাল স্পেশালাইজড হাসপাতাল। চীন তাদের ডাক্তারদের, নার্সদের এবং ভাইরাস মোকাবেলায় জড়িত সকলকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়েছে। আমি ভিডিও দেখেছি যে চীনের ডাক্তাররা কতটা নিরাপদ পোষাক পরে রোগীর কাছে যেতেন। আমাদের ডরিমিটরির যে সিকিউরিটি গার্ড উনিও পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট) পরে থাকতেন। কেন্টিন থেকে আমাদের জন্য রান্না করে আনতেন যে বাবুর্চি তিনিও পিপিই পরে আসতেন।

৭. চীনের সকল জনগণ চীনের সরকারকে সহযোগিতা করেছে। চীনে শুধু সুপারশপ এবং মেডিসিনের দোকান খোলা ছিলো এবং প্রতিটি বিল্ডিং থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হয়েছিলো তাকে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিলো যেটি দেখালেই শুধুমাত্র তিনি সুপারশপগুলোতে ঢুকতে পারতেন। সেই স্বেচ্ছাসেবক বিল্ডিংয়ের সকলের বাজার করে দিতেন।

৮. চীন ১৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল গড়ে তুলেছিল। যেটি অনেক বড় একট ভূমিকা পালন করে। চীন সরকার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করেছিল। চীনে করোনা আক্রান্ত সকল রোগীকে চীন সরকার বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে।

৯. চীন তার প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। রোবট দিয়ে রোগীদের খাবার এবং মেডিসিন দিয়েছে।ড্রোন দিয়ে প্রতিটি রাস্তায় অলিতে গলিতে নজর রেখেছে। ড্রোনের সাথে স্পিকার লাগিয়ে মানুষকে সচেতন করেছে।

১০. চীন সরকার এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করার পরও আমাদেরকে সবসময় সাবধান করে আসছে যে “নতুন কোনো রোগী নেই তার মানে এই না যে কোনো ধরনের রিস্ক নেই”। আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে চলতে বলা হয়েছে। সবসময় মাস্ক পড়তে বলা হয়েছে এবং হাত পরিষ্কার রাখতে বলা হয়েছে।

লেখক: মেডিকেল শিক্ষার্থী, চায়না থ্রি গর্জেস ইউনিভার্সিটি, হুবেই,চীন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply