সুন্দরবন রক্ষায় দরকার জাতীয় অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন

|

ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ:

কেনিয়ার নাইরোবিতে চলছে পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়ো ডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ওপেন এন্ডেট ওয়ার্কিং গ্রুপের চতুর্থ মিটিং। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও এনজিওদের অংশগ্রহণে ৬ দিন ব্যাপী এই মিটিং চলবে ২৬ জুন পর্যন্ত। এই গ্লোবাল মিটিং সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রসঙ্গ।

পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ওপেন এন্ডেট ওয়ার্কিং গ্রুপের কো-চেয়ার বেসিল ভ্যান হাভরে বলেন, সুন্দরবনের মত ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা করা খুবই জরুরি। কারণ অনেক বন্যপ্রাণী এ বনের ইকো সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল। শুধু বন্যপ্রাণী নয় মানুষের জন্যও এই বন রক্ষা করা খুবই জরুরি। এই বন পরিবেশ এবং পানির জন্য ফিল্টারের মত কাজ করে। সুতরাং ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রক্ষা ও সংরক্ষণ করে দীর্ঘমেয়াদে ইকো সিস্টেমের কার্যকারিতা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা ১২ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত এবং ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি।

২০২১ সালে বন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে গত চার বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১১৪টি হয়েছে। অর্থাৎ চার বছরে বাঘ বেড়েছে ৮টি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ মোহসীন-উল হাকিম, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বাড়েনি এটা সত্য। তবে বাঘ এবং হরিণ শিকারগত দুবছরে কমেছে। কিন্তু সুন্দরবনের সমস্যা আরও গভীরে। অল্প সময়ে বেশি মাছ আহরণের জন্য এখানকার জেলেরা পানিতে বিষ ঢেলে সুন্দরবনের খালগুলোতে মাছ শিকার করে। এই জঘণ্য কাজটির ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বহু মাছের প্রজাতি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য প্রাণী ও গাছ। কিন্তু উপযুক্ত আইন এবং মনিটরিংয়ের অভাবে এই জেলেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বনবিভাগ।

মোহসীন-উল হাকিম আরও বলেন, বাংলাদেশের বনবিভাগ খুবই দুর্বল। বাজেট স্বল্পতা, জনবলের অভাব, লজিস্টিকের অভাবের কারণে তারা সুন্দরবনকে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না। তিনি যোগ করেন, সুন্দবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে এবং অধিবাসীদের যদি সরকার আর্থিকভাবে সহায়তা না করে, এবং যদি তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান করা না যায় তবে এই জনগোষ্ঠী নিজেদের জীবন বাঁচাতে বারবার সুন্দরবনে নিজেদের কার্যক্রম চলমান রাখবে। যার ফলে সুন্দরবনকে কখনোই রক্ষা করা যাবে না।

সুন্দরবনের আরও একটি বড় সমস্যা, এর নদী ও খালের পানিতে লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়া। সুন্দরবনে জীবনযাপনে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি সাগরে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মিষ্টি পানি পানে অভ্যস্ত বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের সাথে একমত পোষণ করেন জনাব শরীফ জামিল। যিনি ‘বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ নামক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তার সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।

জনাব জামিল জানান, বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন সংরক্ষণের যে গুরুত্ব তা মানসিকভাবে এখনও অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে সুন্দরবন এখনও অরক্ষিত। বরং সুন্দরবন ধ্বংসের সব ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ উদ্যোগী সরকার। শুধু বাঘ নয়, কোনো প্রাণীর জীবনই সেখানে নিরাপদ নয়। যেহেতু সরকারি উদ্যোগ নেই তাই নিজেদের সচেতন হবার পাশাপাশি শক্তিশালী মনিটরিং টিম তৈরি করতে হবে।

সুন্দরবন তথা বায়োডাইভারসিটি রক্ষায় সরকারের অঙ্গিকারের কথা উঠে এসেছে পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়ো ডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ওপেন এন্ডেট ওয়ার্কিং গ্রুপের সংবাদ সম্মেলনে। টার্গেট ৪ এর নতুন ফ্রেমওয়ার্কে বিশেষত প্রজাতির সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার এবং মানব-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষ এড়াতে বা কমানোর জন্য মানব-বন্যপ্রাণী মিথস্ক্রিয়া কার্যকর ব্যবস্থাপনা উভয়েরই উল্লেখ করে।

পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ওপেন এন্ডেট ওয়ার্কিং গ্রুপের আরেক কো-চেয়ার ফ্রান্সিস ওগওয়াল বলেন, বাংলাদেশের সরকারের বায়ো ডাইভারসিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে মৌলিক জায়াগা হিসেবে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে প্রকৃতি রক্ষায় কোনো ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন নেই, প্রকৃতি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। জাতীয় পর্যায় থেকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অঙ্গীকার না থাকলে কোন কিছুই পরিবর্তন হবে না। আইইউসিএন-এর একজন মুখপাত্রের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য কাঠামোর মাধ্যমে পুনরুদ্ধার অর্জনের জন্য বার্ষিক বৈশ্বিক জিডিপির ০.৭ থেকে ১% এর মধ্যে অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

একই কথার ওপর গুরুত্ব দেন সিবিডির এক্সেকিউটিভ সেক্রেটারি এলিজাবেথ মারুমা ম্রেমা। তিনি বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের কমিটমেন্টের বিকল্প নেই। বিকল্প নেই গ্লোবাল বায়ো ডাইভারসিটির টার্গেটগুলো পূরণেরও।

[[This story was produced as part of a reporting fellowship to the 2022 UN Convention on Biological Diversity’s 4th Meeting of the Open-ended Working Group on the Post-2020 Global Biodiversity Framework, led by Internews’ Earth Journalism Network.]]

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply