মাত্র ৬ মিনিটের মধ্যেই কি নিয়তি হয়ে গেলো নির্ধারিত? সেই ৬ মিনিট আর্লিং ব্রট হাল্যান্ডের। গোল করে ও করিয়ে ইতিহাদ স্টেডিয়াম থেকে বায়ার্ন মিউনিখকে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য করেছেন ৩ গোলে পিছিয়ে থেকে। সেই সাথে জন স্টোনস, রুবেন দিয়াস, নাথান একেদের পারফরমেন্সকে বলা যেতে পারে ‘প্রায় নিখুঁত’। এমন ক্লিনিক্যাল পারফরমেন্স বছরের পর বছর ধরেই করে আসছে পেপ গার্দিওলার দল। কিন্তু সেটা ছিল কেবলই লিগে; চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে এমনটা দেখা যায়নি। এবার জার্মান জায়ান্টদের বিপক্ষে আক্রমণ, রক্ষণ, ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে এখনও পর্যন্ত বলা যেতেই পারে, ইউরোপ সেরার লড়াইয়ে পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটিই ফেভারিট।
অথচ চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্ব মানেই যেন ছিল ম্যান সিটির ভেঙে পড়া, পেপ গার্দিওলার বেশি বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা। ইতিহাদে তেমনটা এবার দেখা যায়নি। রদ্রির ২৭ মিনিটের গোলটি তো চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের আসরের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হতেই পারে। এরপর থেকেই শুরু বায়ার্নের আক্রমণ প্রতিহত করতে গোলপোস্টের সামনে এডারসনসহ রক্ষণে রুবেন দিয়াস, জন স্টোনস, ম্যানুয়েল আকাঞ্জিদের স্নায়ু ও স্কিলের পরীক্ষা। লেরয় সানের একাধিক শটে দারুণ সেইভে সিটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এডারসন। সাথে, রক্ষণ প্রাচীরে প্রতিহত একের পর বায়ার্নের গোলা সাক্ষ্য দেয়, পরের লেগে সিটির রক্ষণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে টমাস টুখেলকে।
বার্নাদো সিলভা এদিন ছিলেন দুর্দান্ত। রিয়াদ মাহরেজকে বসিয়ে রেখে রাইট উইঙে সিলভাকে খেলান পেপ। আর, সেখানেই মাঝমাঠের সাথে আক্রমণভাগের সংযোগ ঘটাতে কেভিন ডি ব্রুইনার সমান্তরালেই খেলেছেন বার্নাদো সিলভা। সাম্প্রতিক সময়ের পারফরমেন্সের সফল অনুবাদ ঘটিয়ে বামপ্রান্তে পুরো ম্যাচেই আধিপত্য করেছেন ম্যান সিটির ‘হান্ড্রেড মিলিয়ন ম্যান’ জ্যাক গ্রিলিশ। দলের প্রাণভোমরা কেভিন ডি ব্রুইনা এ ম্যাচেও ছড়ি ঘুরিয়েছেন মাঝমাঠে। ডেস্ট্রয়ার পজিশনে ডি ব্রুইনার সহায়তায় ইলকায় গুন্দোয়ানও ম্লান করে ছেড়েছেন জোশুয়া কিমিখ, লিওন গোরেজকাদের।
বলার ছিল, দেখানোর ছিল হাল্যান্ডেরও। প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের বেশ খানিকটা সময়ও এই নরওয়েজিয়ান গোলমেশিনকে নীরব রাখতে পেরেছিল বায়ার্ন। কিন্তু কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি জার্মান জায়ান্টরা; হাল্যান্ডের বিপক্ষে যা বাকিরাও করতে পারছে না! ৭০ মিনিটে জ্যাক গ্রিলিশের প্রেসিংয়ে নিজেদের পোস্ট থেকে ২৫ গজ দূরে বলের দখল হারান বায়ার্ন ডিফেন্ডার উপামেকানো। এরপর দারুণ এক ব্যাকহিলে সেই বল গ্রিলিশ বাড়িয়ে দেন আগুয়ান হাল্যান্ডকে। গোলে নিজে শট না নিয়ে হাল্যান্ড বাড়ান পোস্টের বিপরীত দিকে এক দুর্দান্ত ক্রস। অরক্ষিত বার্নাদো সিলভা নিখুঁত হেডে পরাস্ত করেন ইয়ান সমারকে। সিটি পেয়ে যায় দুই গোলের লিড।
চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা শেষ ম্যাচে আরবি লাইপজিগের জালে পাঁচবার বল জড়িয়েছিলেন হাল্যান্ড। এই ম্যাচে একদমই বিপরীত ধরনের খেলা উপহার দিয়েছেন এই নাম্বার নাইন। বায়ার্নকে হারানোর জন্য বল ধরে খেলা এবং বল ছাড়া নিয়মিত জায়গার পরিবর্তন ঘটানো ছিল জরুরি। আর হাল্যান্ড করেছেন ঠিক তাই। প্রথমার্ধে এই ভূমিকা পালনের পর বার্নাদো সিলভাকে দিয়ে গোল করানোর মিনিট ছয়েক পর কফিনে হয়তো শেষ পেরেকটিই ঠুকে দিলেন তিনি। ক্লোজ রেঞ্জ থেকে করা ফিনিশিংয়ে সমারকে পরাস্ত করেন তিনি। ম্যান সিটির জার্সিতে মাত্র ৭ ম্যাচেই হাল্যান্ড পেয়ে গেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে তার ১১ তম গোল। আর, এর মাধ্যমেই প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক আসরে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৫ গোল পেয়ে গেছেন সময়ের সেরা এই স্ট্রাইকার। টপকে গেছেন মোহামেদ সালাহ ও রুড ভ্যান নিস্টেলরয়কে। এই রেকর্ড হয়তো আরও প্রলম্বিত করবেন নরওয়েজিয়ান এই গোলমেশিন। আর সিটিও দেখবে ইউরোপ সেরার মুকুট জয়ের স্বপ্ন।
এই স্বপ্ন তো বহুদিন ধরেই দেখে আসছে ম্যান সিটি। কিন্তু তীরে এসে প্রতিবারই ঢুবছে তরী। এই ম্যাচের আগে রুবেন দিয়াস বলেছিলেন, ২০২১ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের কষ্ট কীভাবে ভুলেছিলেন তিনি। বলেন, একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি আমাকে বলেছিল, আমরা ফাইনাল হারিনি। ফাইনাল জয়ের পথে ছোট্ট একটি ধাপ এগিয়েছি মাত্র।
রুবেন দিয়াস হয়তো নিজে ধারণ করেন কথাটি। তার নেতৃত্বগুণও উদ্ভাসিত হয়েছে বহুগুণে। আর জার্মান ট্যাঙ্কের সামনে তো রীতিমতো পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই পর্তুগিজ ডিফেন্ডার। ম্যাচের শুরুতেই সার্জ গেনাব্রির শট ব্লক করা, এরপর জামাল মুসিয়ালার শট গোলে প্রবেশের আগে একমাত্র বাঁধা হিসেবে খুঁজে পায় পেতে দেয়া দিয়াসের শরীর। মুসিয়ালার এই গোল মিসে সাইডলাইনে দাঁড়ানো টমাস টুখেলের হতাশাও যেন ছিল ম্যাচের প্রতীকী চিত্র।
কিন্তু কেবল দিয়াসই নন, এই ম্যাচে সামর্থ্যের সর্বোচ্চটাই দিয়েছে সিটির সকল ডিফেন্ডার। ম্যাচ সেরা হয়েছেন সারা ম্যাচেই আলো কেড়ে নেয়া জন স্টোনস। একের পর এক নিখুঁত ট্যাকল করে গেছেন ম্যানুয়েল আকাঞ্জি। আর নাথান একেকে ডুয়েলে হারানো হয়ে পড়েছিল রীতিমতো অসম্ভব। অতীতেও চ্যাম্পিয়নস লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অনেক গোল পেয়েছে ম্যান সিটি। কিন্তু রক্ষণের ভুলেই ভুগতে হয়েছে বেশি। কিন্তু বায়ার্নের বিরুদ্ধে সিটি রক্ষণের এমন পারফরমেন্সে মনে হতেই পারে, এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটির কাছে আর অধরা থাকবে না চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা।
/এম ই
Leave a reply