আল মাহফুজ:
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বয়স প্রায় দেড়শ’ বছর। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় বিশ হাজার আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ক্রিকেটের এমন অনেক ‘আউট’এর সংজ্ঞা রয়েছে, এই দেড়শ’ বছরে মাঠে যা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি দর্শক। ক্রিকেটে ক্যাচ, বোল্ড, রানআউট, এলবিডব্লিউ ইত্যাদি আউটের দেখা পাওয়া যায় হরহামেশা। রিটায়ার্ড আউট, হিট উইকেটেরও দেখা পাওয়া যায় মাঝে মধ্যে। যেগুলো একটু অদ্ভুতুড়ে– ‘হ্যান্ডলড দ্য বল’, ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’। এগুলো দুর্লভ হলেও দেখা গেছে। কিন্তু ‘টাইমড আউট’-এর দেখা পাওয়া যায়নি এতোদিন। অবশেষে সেটাও দেখা গেলো এই বিশ্বকাপে, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে।
ম্যাচের ২৪ দশমিক ২ বলের সময় সাকিবের বলে সাদিরা সামারাবিক্রমা আউট হলে ক্রিজে আসেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। একটি পুরনো হেলমেট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ম্যাথুস। যে হেলমেট নিয়ে নেমেছিলেন, তার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যাওয়াতে পুরো নিরাপদ বোধ করেননি তিনি। তাই পরে আরেকটি হেলমেট আনা হয়। কিন্তু সেটিও তার কাছে খেলায় ব্যবহার উপযোগী মনে না হওয়ায় সময়ক্ষেপণ করছিলেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আউটের আবেদন জানান।
এমসিসির আইনের ৪০.১.১ নম্বর ধারা অনুযায়ী ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’ ঘোষণা করেন আম্পায়ার। আইসিসির নতুন নিয়ম অনুযায়ী, টেস্ট ও ওয়ানডে ফরম্যাটে আউট হওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে নতুন ব্যাটারকে ক্রিজে এসে প্রথম বল খেলার প্রস্তুতি নিতে হবে। আগে এই সময়টা ছিল তিন মিনিট। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টিতে এই টাইম ফ্রেম ৯০ সেকেন্ডের। ম্যাথুস অতিক্রম করে গেছেন দু’মিনিট। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘টাইমড আউট’ হওয়া প্রথম ব্যাটার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন তিনি।
তবে এই আউটের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর থেকে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এমন ঘটনা আগে দেখেনি, তাই অভূতপূর্ব এই ঘটনার সাথে ‘ক্রিকেটের চেতনা’র প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। নাড়াচাড়া হচ্ছে আইনের খেরোখাতা নিয়ে। এই আউটকে যেমন ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। অনেকে আবার এটিকে আইনসিদ্ধ বলে দেখছেন। তবে চলুন, ঘুরে আসি ইতিহাসের মাদুরে, ক্রিকেটের ম্যাচের খণ্ডচিত্রে—
‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’ বনাম ওভারথ্রো রান
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১। কলকাতা ও দিল্লির আইপিএল ম্যাচ। আগে ব্যাট করা দিল্লির ইনিংসের ১৯তম ওভারের শেষ বলে রাহুল ত্রিপাঠির করা থ্রো এসে ঋষভ পন্তের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করেছিল। সেই ওভারথ্রো থেকে আরেকটা রান নিয়েছিলেন পন্ত ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন। মাঠে এ নিয়ে কলকাতার টিম সাউদি ও এউইন মরগানের সঙ্গে একচোট বচসা হয়েছিল অশ্বিনের। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অশ্বিন বলেন, সাউদি বা মরগান কারোরই ‘নৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার অধিকার’ নেই।
আইপিএলের প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী, ওভারথ্রো থেকে রান নিতে ব্যাটারের কোনো বাধা নেই (‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’ আউটের জন্য আলাদাভাবে নির্দিষ্ট ধারা রয়েছে আইনে)। ফিল্ডারের থ্রো ব্যাটারের গায়ে এসে লাগলে এরপর সাধারণত রান নেন না ব্যাটসম্যানরা। তবে আইন বলে, সেই ওভারথ্রো থেকে বাউন্ডারি হলে আম্পায়ারকে সেটা দিতেই হবে। প্রশ্ন ওঠে, আইন যেখানে রান নেয়ার বৈধতা দিচ্ছে, সেখানে নৈতিকতার প্রসঙ্গ কেন উঠছে? ‘ক্রিকেটীয় চেতনা’ ও ‘আইন’, এ দুটিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন অশ্বিন।
এরকম এক ঘটনা ঘটে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালেও। সে ম্যাচে খুব গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ওভারথ্রো থেকে আসে একটি বাউন্ডারি। ইংলিশদের যখন জয়ের জন্য ৩ বলে ৯ রান দরকার ছিল, তখন কিউই ফিল্ডার গাপটিলের থ্রো স্টোকসের ব্যাটে লেগে বাই হয়ে সীমানা পেরিয়ে যায়। দৌড়ে ২ রান আর ৪ রান মিলিয়ে মোট ৬ রান পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। পরে টাই হয় ম্যাচ (বেশি বাউন্ডারি মারার কারণে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড!)। অবশ্য আইন বলে, ওটা ৫ রান হবে, ছয় না। কিন্তু ততক্ষণে ফাইনালের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বল বাউন্ডারি দড়ি পেরোনোর পর স্টোকস দুহাত প্রসারিত করে নত ভঙ্গিমায় যেন বোঝাচ্ছিলেন, এই রান পাওয়াটা তার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ম্যাচ তো হেরে যায় নিউজিল্যান্ড। সেই এক রানের হিসেবের ভুলে বিশ্বকাপের ট্রফিটি এতো কাছে গিয়েও উঁচিয়ে ধরতে পারেনি কেন উইলিয়ামসন। এখানেও ক্রিকেটীয় চেতনার কথা আসে। গুঞ্জন ওঠে, স্টোকস নাকি আম্পায়ারের কাছে সেই চার রান ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলে। কিন্তু নাহ, স্টোকস তা করেননি। তিনি আম্পায়ারকে বলেননি সে কথা। আইন মেনেই রান আদায় করেছেন তিনি এবং তার দল তাতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অবশ্য সেই বিশ্বকাপের পর বেশি বাউন্ডারি মারার কারণে ম্যাচ জেতার অদ্ভুত নিয়মটি বাতিল করে আইসিসি।
‘মানকাডিং’ বনাম নট আউট
‘মানকাড’ বা নন-স্ট্রাইক প্রান্তের ব্যাটারকে রানআউট করেও বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী এমন আউট করার অধিকার বোলারের রয়েছে। কেননা, এতে আইন বিরুদ্ধ বাড়তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে থাকে ব্যাটার। সেটা যাতে না করতে পারে, তাই এই নিয়ম। তবে একদা এটাকে ক্রিকেটীয় চেতনার বিরোধী মনে করতেন অনেকেই। কিন্তু এখন ‘মানকাড’কে সাধারণ আউট হিসেবেই ধরা হয়। আর থাকছে না বিতর্কের জায়গা। অশ্বিনের মতে, আইন অনুযায়ী কাউকে আউট করলে সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়।
৩ জুন, ২০১৪। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডের সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে ইনিংসের ৪৪তম ওভারে জশ বাটলারকে ‘মানকাডিং’ আউট করেছিলেন লঙ্কান স্পিনার সচিত্রা সেনানায়েকে। সে ম্যাচ জিতে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজও জয় করে শ্রীলঙ্কা। সেদিন কিন্তু ‘ক্রিকেটীয় চেতনা’ ধারণ করে আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়নি তখনকার অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের পক্ষ থেকে। বরং ম্যাচ শেষে ম্যাথুস জানিয়েছিলেন, ক্রিকেটের নিয়ম মেনেই মানকাড করা হয়েছে। ওই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তৎকালীন ইংলিশ অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। সেবার মানকাডিং নিয়ে আপত্তি না জানানো ম্যাথুস এবার নিজের ‘টাইমড আউট’ হওয়া নিয়ে আপত্তি জানালেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দল বা পরিস্থিতিভেদে কি ‘ক্রিকেটীয় চেতনা’র পক্ষ বদল হয়?
‘ক্রিকেটীয় চেতনা’ বনাম আইনসিদ্ধ আউট
২০০১’এ এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কান মারভান আতাপাত্তু ডাবল সেঞ্চুরি এবং মাহেলা জয়াবর্ধনে দেড়শ’ করার পর ‘রিটায়ার্ড আউট’ হয়ে চলে যান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেই আউটের জন্ম দেয় লঙ্কান বাহিনী। তার আগ পর্যন্ত ‘রিটায়ার্ড আউট’ নামক কোনো কিছুর সাথে পরিচিত ছিল না কেউই। কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে যেমন, তেমনি আছে সূচনাও।
২০০৯’এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে রান তাড়া করছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। দারুণ খেলা গ্রায়েম স্মিথ ইনিংসের এক পর্যায়ে ইনজুরিতে পড়েন। রানারের জন্য তিনি স্ট্রাউসের সম্মতি চাইলে তখন সম্মতি জানাননি ইংলিশ অধিনায়ক। সেই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা পরাজয় বরণ করে এবং গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয়। স্ট্রাউস তখন প্রচুর সমালোচনার শিকার হলেও পরবর্তীতে কিন্তু আইসিসি রানার নেয়ার নিয়মটি বাতিল করে। সব কিছুর শুরু আছে যেমন, তেমনি আছে সমাপ্তিও।
আইন অনুযায়ী কেউ আউট হলে অথবা রান সংগ্রহ করলে সেটা আপনার কাছে অপমানজনক মনে হলেও সেটাকে কি ক্রিকেটের স্পিরিটের বিরুদ্ধে বলা যায়? আর যদি কোনো আইন ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থীই হয়, তাহলে সেটা বাতিল করে দিলেই হয়! কারণ, আইন যুগে যুগে পরিবর্তন হয়। মানুষের জন্যই আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়। কালের বিবর্তনে ক্রিকেট থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে (‘বডিলাইন সিরিজ’, ‘আন্ডার আর্ম বোলিং’), আবার অনেক আইন যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। সুতরাং ভাবতে হবে, ক্রিকেটীয় চেতনা ও আইনের সম্মিলন কীভাবে করা যায়। আইন এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে ‘ক্রিকেটীয় চেতনা’র সাথে সংঘর্ষটা তুলনামূলক কম থাকে।
ক্রিকেটের বর্তমান কন্ডিশন দেখলে বোঝা যায়– আইসিসি খেলাটাকে গতিশীল করার জন্য বহু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওভার শেষ না করতে পারলে ম্যাচ ফি জরিমানা, ডিমেরিট পয়েন্ট, ইন ম্যাচ পেনাল্টিসহ চালু করেছে বহু নিয়ম। ‘টাইমড আউট’এর সময়ফ্রেমও কমিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন নিয়মে। জরিমানা অথবা সাসপেনশনের হাত থেকে বাঁচতে তাই যেকোনো অধিনায়কের অধিকার আছে টাইমড আউটের পক্ষে আপিল করার। সেই নিয়ম মেনেই আম্পায়ার আউট দিয়েছেন লঙ্কান ব্যাটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে।
গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের বিখ্যাত একটি উক্তি আছে– ‘একই নদীতে দুবার গোসল করা অসম্ভব। এমনকি একবারও সম্ভব নয়। কারণ, স্রোতের অংশ বিশেষ স্পর্শ করার পূর্বেই সে স্রোত বাহিত হয়ে যায়।’ তার এই উক্তির পেছনে একটি চিরন্তন সূত্র কাজ করেছে– জগতের সবকিছু পরিবর্তনশীল। কোনো কিছুই স্থির নয়। সে কথার সূত্র ধরে আমরাও বলতে পারি, ক্রিকেটের আইনও পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তিত আইনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলে ক্রিকেটীয় চেতনার বিরোধটাও কমে যাবে। সেটা দর্শক হিসেবে যেমন, খেলোয়াড় হিসেবেও তেমন।
Leave a reply