ক্রিকেটে চোকার্স শব্দটি শুনলেই ক্রীড়া প্রেমীদের সর্বপ্রথমেই দক্ষিণ আফ্রিকার কথা মনে পড়বে। কেননা, চোক শব্দটি দক্ষিণ আফ্রিকার একদম পরিপূরক শব্দ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখনও অবধি চারবার সেমিফাইনাল খেলেও একবারের জন্যও ফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি তারা। পঞ্চমবারে এসেও সেমির জুজু কাটাতে পারলো না প্রোটিয়ারা। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছে ৩ উইকেটে।
আগে ব্যাট করতে নেমে ডেভিড মিলারের সেঞ্চুরির পরও মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্সের বোলিং তোপে ২১২ রানে গুটিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ট্রাভিস হেডের অর্ধশতকে ১৬ বল হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় মাইটি অজিরা। এই জয়ের ফলে ৮ বছর পর ফাইনালে উঠলো প্যাট কামিন্সের দল।
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার দেয়া ২১৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও ট্রাভিস হেডের ব্যাটে উড়ন্ত শুরু পায় অজিরা। ইনিংসের শুরু থেকেই প্রোটিয়া বোলারদের উপর চড়াও হয়ে খেলেন দুই অজি ওপেনার। মার্কো ইয়ানসেন-কাগিসো রাবাদাদের কোনো সুযোগই দেননি তারা। শুরু থেকেই একের পর এক বাউন্ডারি মেরেছন তারা। প্রোটিয়া বোলারদের তুলোধুনো করে মাত্র ৬ ওভারে দু’জনে মিলে তুলেন ৬০ রান।
এরপরই মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখে অস্ট্রেলিয়া। ১ রানের ব্যবধানে ২ উইকেট হারায় অজিরা। মার্করামের বলে একটু জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন ওয়ার্নার। দারুণ ছন্দে থাকা বাঁহাতি এই ওপেনার আউট হন ১৮ বলে ২৯ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলে। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেও এদিন রানের খাতাই খুলতে পারেননি মিচেল মার্শ। রাবাদার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে জোরের উপরে খেলেছিলেন ডানহাতি এই ব্যাটার। কভারে দাঁড়িয়ে থাকা ডাসেন ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন। ডাসেনের ‘অবিশ্বাস্য’ ফিল্ডিংয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় মার্শকে।
দ্রুত ২ উইকেট হারানোর পরও অস্ট্রেলিয়াকে চাপে পড়তে দেননি হেড ও স্মিথ। ৪০ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে অস্ট্রেলিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন হেড। দারুণ ব্যাটিং করতে থাকা হেডকে ফেরান মহারাজ। বাঁহাতি এই স্পিনারের ঝুলিয়ে দেয়া ডেলিভারিতে সামনের পায়ে ভর দিয়ে ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন হেড। বাঁহাতি এই ব্যাটারের ব্যাট-প্যাডের মাঝে অনেকটা ফাঁকা ছিল। সেখান দিয়ে মহারাজের ঝুলিয়ে দেয়া ডেলিভারি আঘাত হানে হেডের স্টাম্পে। বাঁহাতি এই ওপেনার ফিরে যান ৬২ রানের ইনিংস খেলে।
মার্নাস ল্যাবুশেনকে বেশিক্ষণ টিকতে দেননি শামসি। বাঁহাতি এই স্পিনারের বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়েন তিনি। রিভিউ নিলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি ১৮ রান করা এই ব্যাটারের। ক্রিজে এসে দ্রুতই ফিরে যান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। শামসির শর্ট ডেলিভারিতে পুল করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে বলের লাইন মিস করে ফিরে গেছেন বোল্ড হয়ে। নিজের সবশেষ ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করা ম্যাক্সওয়েল এদিন আউট হয়েছেন ১ রানে।
সবশেষ ৬৭ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে তাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় স্মিথ ও জশ ইংলিস জুটি। তারা দু’জনে মিলে যোগ করেন ৩৭ রান। স্মিথকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন জেরাল্ড কোয়েৎজে। ডানহাতি এই পেসারের শর্ট লেংথ ডেলিভারিতে উইকেট থেকে বেরিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে গিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন। বল সোজা উপরে উঠে যাওয়ায় ক্যাচ লুফে নেন ডি কক। লম্বা সময় টিকে থাকা স্মিথকে ফিরতে হয় ৬২ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলে।
স্মিথ ফেরার পর স্টার্ককে সঙ্গে নিয়ে ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন ইংলিস। তখনও হাতে পর্যাপ্ত বল থাকায় চাপ নেয়ার তেমন প্রয়োজন ছিল না তার। অস্ট্রেলিয়া যখন জয় থেকে ২০ রান দূরে তখন সাজঘরে ফেরেন ইংলিস। কোয়েৎজের বলে বোল্ড হয়ে ফিরে যান ৪৯ বলে ২৮ রান করা অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার ব্যাটার। তবে ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ শেষ করেন কামিন্স ও স্টার্ক। প্রোটিয়াদের হয়ে দু’টি করে উইকেট নেন কোয়েৎজে ও শামসি। এছাড়াও একটি করে উইকেট নেন কাগিসো রাবাদা, কেশভ মহারাজ ও এইডেন মার্করাম।
এর আগে, টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই চাপে পড়ে প্রোটিয়ারা। ইনিংসের শুরু থেকেই উইকেট থেকে দারুণ সুইং আদায় করেন স্টার্ক-হ্যাজলউডরা। প্রথম ওভারেই অস্ট্রেলিয়াকে ব্রেক থ্রু এনে দেন স্টার্ক। বাঁহাতি এই পেসারের অফ স্টাম্পের কিছুটা বাইরে পিচ করা ডেলিভারি বেরিয়ে যাওয়ার মুখে খোঁচা মারেন বাভুমা। ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল চলে যায় পেছনে। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ ক্যাচ নেন জশ ইংলিস। শূন্য রানেই ফিরতে হয় তাকে।
পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা কুইন্টন ডি ককও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভালো শুরু এনে দিতে পারেননি। শুরুতে সময় নিলেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি বাঁহাতি এই ব্যাটার। হ্যাজলউডের লেংথ ডেলিভারি বেরিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন ডি কক। টাইমিং না হওয়াতে টপ এজ হয়ে বল উঠে যায় অনেক উঁচুতে। বলে চোখ রেখে মিড অন থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে মাথার উপর থেকে চমৎকার ক্যাচ নেন প্যাট কামিন্স। ১৪ বলে কেবল ৩ রান করে ফেরেন ডি কক।
ক্রিজে এসে ইনিংস বড় করতে পারেননি এইডেন মার্করামও। স্টার্কের ফুল লেন্থের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে পয়েন্টে ডেভিড ওয়ার্নারের হাতে ধরা পড়েন মার্করাম।এই মিডল অর্ডার ব্যাটার ২০ বলে দুই চারে করেন ১০ রান। এদিকে ৩ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অনেকটা সময় ক্রিজে পড়ে থেকেও যেন থিতু হতে পারছিলেন না রাসি ফন ডার ডুসেন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগান অজি পেসার হ্যাজলউড। অনেকটা ফুলার লেংথের বল পা বাড়িয়ে ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন ডুসেন। ঠিক মতো খেলতে পারেননি, ব্যাটের কানায় লেগে জমে পড়ে স্লিপে, স্টিভেন স্মিথের হাতে। ৩১ বলে ডুসেন করেন ৬ রান।
এরপর ধুঁকতে থাকা দলকে পথ দেখান ডেভিড মিলার ও হেনরিখ ক্লাসেন জুটি। শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে দু’জনই থিতু হয়েছেন উইকেটে। অজি বোলারদের হতাশ করে রানের গতিও বাড়ান মিলার ও ক্লাসেন। তাদের দারুণ এই জুটিতে ১০০ পেরোয় আফ্রিকার ইনিংস। ক্রিজে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে খেলছিলেন দুই ব্যাটার, হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন মিলার।
৩১তম ওভারে বাধ্য হয়েই পার্ট টাইমার ট্রাভিস হেডকে বোলিংয়ে আনেন কামিন্স। আর এতেই ভাঙে ৯৫ রানের জুটি। ৪৮ বলে ৪৭ রান করা ক্লাসেনকে বোল্ড করে জুটি ভাঙেন হেড। পরের বলেই মার্কো ইয়ানসেনকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে আবারও ম্যাচের গতিপথ অজিদের পক্ষে নিয়ে আসেন হেড।
১১৯ রান ৬ উইকেট হারানো দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের হাল ধরে রাখেন মিলার, তাকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন জেরাল্ড কোয়েৎজে। ৫৩ রানের এই জুটি অজিদের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত ১৯ রান করা কোয়েৎজেকে ১৯ রানে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন কামিন্স।
সবাই ফিরে গেলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে একাই লড়াই করেন মিলার। অজি বোলারদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে তুলে নেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। কামিন্সের বলে ছয় মেরে ৪৭ তম ওভারে পান ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি পাওয়ার পরপরই অবশ্য ফেরেন মিলার। তার ১০১ রানের ইনিংসের সুবাদেই ২০০ পেরোয় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ২১২ রানে অলআউট হয় তারা। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তিনটি করে উইকেট নেন মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্স। দু’টি করে উইকেট শিকার করেন জশ হ্যাজলউড ও ট্রাভিস হেড।
১৯ নভেম্বর আহমেদাবাদে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ভারত।
/আরআইএম
Leave a reply