মেসির স্বপ্নপূরণের রাত, আর্জেন্টিনার অধরা বিশ্বজয়ের এক বছর

|

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ছিলো মেসির, আর্জেন্টিনার, সেই সাথে কোটি ভক্তদের। ছবি: গেটি ইমেজ।

আহাদুল ইসলাম:

সালটা ছিল ২০২২। ইংরেজি ক্যালেন্ডার বলছে ১৮ ডিসেম্বর। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুললেই দেখা মিলছে আকাশি-সাদা রঙের পতাকা। ঘরের বাইরে চায়ের দোকানে চলছে তুমুল তর্ক। কেউ বলছে, এবারও শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে পরাজিতের দলে থাকবে আর্জেন্টিনা। ঠিক যেমন ২০১৪ সালের ফাইনালে ঘটেছিল। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার এক সমর্থক বললো, ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। বারবার না! মেসি ‘ম্যাজিক্যাল’ কিছু উপহার দিয়ে ৩৬ বছরের এই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটাবে। দেখে নিও। একথা শুনে পাশে থাকা ব্রাজিলের এক সমর্থক খোঁচা মেরে বললো, কেন! ২০১৪ সালে কি মেসি ছিল না? এরপর শুরু হল বাগযুদ্ধ।

এরকম ছোট ছোট বহু গল্প ছিল কাতার বিশকাপের ফাইনাল ঘিরে। ম্যাচের আগে অনেকেই বাণিজ্যিক অফারের আয়োজন করেছিল। যেমন ধরুন, আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হলে তাদের প্রোডাক্টে ৪০ পারসেন্ট অফ। হোক সেটা পিজ্জা কিংবা জার্সি।

তবে বিশ্বকাপের শুরুটা মোটেই ভালো ছিল না আলবিসেলেস্তের। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ। প্রতিপক্ষ দুর্বল সৌদি আরব। ‘দুর্বল’ শব্দটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। খেলা শুরুর ১০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি। দলকে লিড দিলেন এলএমটেন। প্রথমার্ধ শেষ। এরপরই ম্যাচ ১৮০ ডিগ্রি ইউটার্ন নেয়। সৌদি ৪৮ মিনিটে গোল করে ম্যাচে সমতায় ফিরলো। ৫ মিনিটের ব্যবধানে আবার গোল। বহু চেষ্টার পরও ম্যাচে ফিরতে পারলো না মেসির দল।

ম্যাচ শেষে চায়ের দোকানে তুমুল বাগযুদ্ধ। রীতিমতো তিরস্কারের বান আসতে শুরু করলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের সমর্থকদের কাছ থেকে। একজন তো বলেই বসলেন, খুব কাপ নেবে আর্জেন্টিনা! সৌদির সাথেই পারে না। উত্তরে এক প্রবীণ আর্জেন্টিনার ভক্ত বললেন, নবী-রাসুলের দেশ! সেই সন্মান রেখে প্রথম ম্যাচটা নাহয় হেরেই গেলাম! পরবর্তীতে ভালো খেলবে আর্জেন্টিনা। কে জানতো, প্রবীণ সেই ভক্তের কথা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে যাবে।

৩ দিন পর ব্রাজিলের গ্রুপ পর্বের প্রথম খেলা সার্বিয়ার বিপক্ষে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা অপেক্ষা করছিলো, কখন ব্রাজিল হারবে আর সৌদির বিপক্ষে হারের আক্ষেপের প্রতিশোধ নেয়া যাবে! কিন্তু আশায় গুড়ে বালি। অনেকের মতে, সেই বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিপক্ষে করা রিচার্লিসনের ‘বাইসাইকেল গোল’টি ছিল অন্যতম সেরা।

সৌদির বিপক্ষে হেরে অনেক চাপে ছিলো মেসির দল। পরের খেলা মেক্সিকোর বিপক্ষে। জিততেই হবে আর্জেন্টিনার। হারলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাবে আলবিসেলেস্তে। মেক্সিকোর জালে ২ গোল দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আর্জেন্টিনা। যার মধ্যে এলএমটেনের ছিল অসাধারণ একটি গোল।

আর্জেন্টিনার পরের ম্যাচ লেভানদোভস্কির পোল্যান্ডের বিপক্ষে। এই ম্যাচেও পোলিশদের ২ গোল দেয় স্কালোনি বাহিনী। তবে ম্যাচের ৬৭ মিনিটে হুলিয়ান আলভারেজের গোলটি ছিলো দেখার মতো, মনে রাখার মতো।

এদিকে, গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে বেঞ্চ পরীক্ষা করে ভুলের মাশুল দিলো ব্রাজিল। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পরও ম্যাচ ছিল গোলশূন্য অবস্থায়। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে গোল করে ব্রাজিলিয়ান শিবিরকে স্তব্ধ করে দেন আবুবকর। খেলা শেষে এদেশের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এলেন সমতায়। গ্রুপ পর্বে দুদেশই একটি করে ম্যাচ হেরেছে। তাই তাদের অনুভূতি প্রায় একই রকম।

এরপর শুরু হয় ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’। ৪ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচের ৩৫ মিনিটে দলকে দারুণ এক গোল করে লিড দেন মেসি। তারপর আরেকটি গোল করে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নিয়ে যান আলভারেজ।

আর্জেন্টিনা জিতলে ব্রাজিল হারবে, বিশ্বকাপের সময় এমন ভাবাটা গুরুতর অপরাধ। দুদিন পর ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়া। এক প্রকার গোল উৎসব করে হেসেখেলে প্রতিপক্ষের জালে ৪ গোল দেয় ব্রাজিল। ম্যাচ শেষ হলে ব্রাজিল সমর্থকদের মিছিলে উত্তাল ঢাকার রাজপথ। সমর্থকরা ধরেই নিয়েছে, কাতার বিশ্বকাপ এবার সেলেসাওদের। কে জানতো, নাটক তখনও বহু বাকি!

কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল যেন ‘নাটক’ শব্দটিকেও হার মানাবে। হাইভোল্টেজ দুই ম্যাচ, তাও আবার ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে। প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া, যারা আগের বিশ্বকাপের রানারআপ। লুকা মডরিচ, পেরিসিচ ও কোভাচিচ আতঙ্কে ভেতরে-ভেতরে কাঁপছে ব্রাজিল সমর্থকদের হৃদয়।

অভিজ্ঞতায় ব্রাজিল এগিয়ে থাকলেও ক্রোয়েশিয়া যে হেলাফেলা করার মতো দল নয়, এ কথা ভালোভাবে জানতো সেলেসাওরা। ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করেছিলো তারা। কিন্তু যা হওয়ার তাই তো ঘটবে, এটাই নিয়তির খেলা। নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য থাকার পর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের একদম শেষে ছোট পাসে ক্লাসিক ব্রাজিলিয়ান স্টাইলে গোল করলেন ব্রাজিলের কাণ্ডারি নেইমার। বিরতির পর ম্যাচ প্রায় শেষ পথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে হাজারো ভক্ত তখন স্মরণ করছিলেন ঈশ্বরকে। দোয়া করছিলেন আর মাত্র ৩ মিনিট। কিন্তু এই ম্যাচের পরিণতি বিধাতা লিখে রেখেছিলেন অন্যভাবে। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে ব্রুনো পেতকোভিচ কোটি ভক্তের হৃদয় ভেঙ্গে গোল করেন এবং দলকে সমতায় ফেরান।

এরপর শুরু হয় নাটক। মারকুইনোস ও রদ্রিগোর মিস শটে টাইব্রেকারে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো ব্রাজিল। এদিকে, ব্রাজিলের হারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা সমর্থকরা রাতেই বের করলো মিছিল। উদ্দেশ্য একটাই! ব্রাজিলের সমর্থকদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া। ঐদিকে, ব্রাজিলের সমর্থকরা রেগেমেগে আগুন। এক সমর্থক তো বলেই বসলেন, একটু পর তোমাদেরও কিন্তু কাঁদতে হবে।

শুরু হয় দ্বিতীয় হাইভোল্টেজ ম্যাচ। আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। আর্জেন্টাইনদের চোখে চোখ রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ডাচরা। খেলার ৩৫ মিনিটে গোল করেন আর্জেন্টাইন মলিনা। কিন্তু গোলটির পেছনে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মেসি। তার জাদুকরি অ্যাসিস্টে লিড নেয় আর্জেন্টিনা। ৭৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলের ব্যবধান দ্বিগুণ করেন মেসি। খেলার ৮৩ মিনিটে দুর্দান্ত হেডে গোল করে ব্যবধান কমান ডাচ তারকা উইঘোর্স্ট।

খেলা শেষ হতে মাত্র ১ মিনিট বাকি ছিল। ১ মিনিট কাটিয়ে দিতে পারলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হতো আর্জেন্টিনার। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে ডি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি কিক পায় নেদারল্যান্ডস। দারুণ ফ্রি কিক থেকে বুদ্ধিদীপ্ত গোল করে ডাচদের ম্যাচে ফেরান সেই উইঘোর্স্ট।

ম্যাচ গড়ালো অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। এরপর আবার নাটক! ব্রাজিলের সমর্থকরা ভেবেছিলো, আর্জেন্টিনা হয়তো পেনাল্টি শুটআউটে বাদ পড়বে। ঘটনা ঘটলো উল্টো। বার্লিন ওয়াল ভেঙ্গে যেতে পারে, কিন্তু আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে পার করে গোল করা সম্ভব নয়। অন্তত ওইদিনের জন্য।

ঠিক তাই হলো। ভার্জিল ফন ডাইকের শট রুখে দিয়ে রাগান্বিত মেজাজে ভক্তদের উদ্দেশে দুহাত তুলে উল্লাস করলেন এমি। এরপর স্টিভেন বেরঘুইসের মিসের পর একটু নেচে নিলেন তিনি। শেষমেশ, জয় ছিনিয়ে সেমিফাইনালে গেলো আর্জেন্টিনা। পার্শ্ববর্তী বন্ধু দেশ ভালো করলে আনন্দ লাগে, কিন্তু সেমি-ফাইনালে গেলে দুঃখ লাগে অনেক। সিনেমার লাইন, কিন্তু ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের অনুভূতি অনেকটা তাই।

দুঃখ নিয়ে এবার শত্রু শিবিরে সমর্থন ব্রাজিল সাপোর্টারদের। ক্রোয়েশিয়ার কারণে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ থেকে বিদায়। তারপরও চিরশত্রু আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করতে নারাজ তারা। অবশেষে, ১৪ ডিসেম্বর শুরু হলো সেমিফাইনাল। খেলা শুরুর আগে সবাই ক্রোয়েশিয়ার গুণ কীর্তনে ব্যস্ত। রিয়াল মিডফিল্ডার মদরিচ ধ্বংস করে দেবে আর্জেন্টিনাকে, এমনটাই বলাবলি হচ্ছিল। তবে খেলা শুরুর পর দেখা গেলো উল্টাে চিত্র। অনেকটা হেসেখেলে ৩ গোল দিয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেলো মেসির দল।

এরপর ১৮ ডিসেম্বরের সেই ফাইনাল। লুসাইল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাতে শুরু হয় ম্যাচ। দুদলেরই লক্ষ্য ছিল, তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতা। শুরু থেকেই ফরাসি শিবির কাঁপিয়ে তোলে মেসিরা। ম্যাচের ২৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে দলকে লিড উপহার দেন লিও। আর্জেন্টিনার ফাইনাল ম্যাচ, আর ডি মারিয়া গোল করবেন না, তা কি হয়? ডি মারিয়ার গোলে প্রথমার্ধেই ২-০ লিড নিয়ে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।

দ্বিতীয়ার্ধে ৭৭ মিনিট পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো। এরপর শুরু হয় এমবাপ্পে তাণ্ডব! ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে জোড়া গোল করে আর্জেন্টিনার গ্যালারি ভর্তি সমর্থকদের একেবারে নীরব করিয়ে দেন এই ফরাসি প্লেয়ার।

এদিকে, পরপর ২ গোলের পর ব্রাজিল সমর্থকদের আনন্দের যেন শেষ নেই। গলিতে গলিতে মাঝ রাতে মিছিল করছে সেলেসাও ভক্তরা। মুখে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান। স্লোগান শুনে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মাথায় রক্ত ওঠার উপক্রম। চলছে খেলা। টানটান উত্তেজনা। আর্জেন্টিনা শিবিরে মারাকানার ফাইনালের তিক্ত অতীতের পুনরাবৃত্তির ভয়।

নির্ধারিত সময়ের খেলা ২-২ সমতা থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এবার আবারও গোল করে দলকে এগিয়ে নেন অধিনায়ক মেসি। উল্লাসে মেতে ওঠেন আকাশি-সাদারা। এই গোলেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতে গেছে ধরে নেন কেউ কেউ। কিন্তু ম্যাচে হয় আবারও টুইস্ট। পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। গোল করে নিজের হ্যাট্রিক পূরণ করেন এমবাপ্পে।

ফাইনাল বাঁশি বাজার কয়েক সেকেন্ড আগে কোলোমুয়ানির শট অবিশ্বাস্যভাবে সেভ করেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। মার্টিনেজ যদি ওই শট সেভ না করতেন, তাহলে গল্প অন্য কিছু হতে পারতো। এরপর শুরু হয় স্নায়ু চাপ বাড়ানো টাইব্রেকার! চাপকে জয় করে শিরোপা উল্লাস করেন মেসি-ডি মারিয়ারা। কাতার থেকে খালি হাতে ফেরা হয় না মেসিদের। অনেকের মতে, সর্বকালের অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ ছিলো এটি।

আজ ঠিক ১ বছর পর, সেই স্মরণীয় মুহূর্তে ফিরে যেতে চাইবে প্রত্যেকটি আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। কেন করবে না? ফুটবল জাদুকরকে অধরা বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরে উল্লাস করার দৃশ্য কেবল স্বপ্নেই দেখতো তারা। অবশেষে ইচ্ছাপুরণ হলো মেসির, পূরণ হলো কোটি ভক্তদেরও স্বপ্ন। ভামোস আর্জেন্টিনা!


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply