আহমদ আফরোজ
পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের তাগিদে ভাষা উদ্ভাবন করে মানুষ। ভাষা উদ্ভবের আগে শারীরিক নানা অঙ্গভঙ্গি এবং পরে মৌখিক নানা প্রকারের শব্দ ব্যবহার করেছে মানুষ। একটা সময় শব্দগুলো মিলেমিশে পেয়েছে অর্থ। জন্ম নিয়েছে ভাষা। ধ্বনির প্রতীক আবিস্কারের সফলতা ভাষাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। শুরু হয় ভাষার নবযাত্রা। স্থান কাল পাত্র ভেদে একটি ভাষা থেকে জন্ম নিয়েছে হাজারো ভাষা। নতুন ভাষা যেমন জন্ম নিয়েছে, তেমনি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে প্রাচীন শত শত ভাষা। আর যেহেতু একটি ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি জাতির আদি ইতিহাস; তাই ভাষা হারিয়ে গেলে জাতিও হারিয়ে যায়। পৃথিবীব্যাপি বিপন্ন ভাষা রক্ষায় অনেক জাতি দেশ সংস্থা নতুন করে তৎপর হলেও সংকটে রয়েছে হাজারো ভাষা।
পৃথিবীর ভাষাচিত্র
বিশ্বব্যাপি ভাষা নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এবং ভাষা গবেষণা ও অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ইথনোলগ। ইথনোলগ এর পুরো নাম ইথনোলগ লিগ অব ওয়ার্ল্ডস। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইথনোলগ তাদের ২১তম সংস্করণে প্রকাশ করে জানায়, বিশ্বের ১৪১টি ভাষা পরিবারের ৭,০৯৭ সচল ভাষা রয়েছে। ২০১৭ সালে তাদের ২০তম সংস্করণে সংখ্যাটি ছিল ৭০৯৯। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত ৩৭০টি ভাষারও তালিকা প্রকাশ করে তারা। তবে ইউনেস্কোর তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ৬ হাজার ৭০০টি ভাষা আছে। তাদের তথ্যমতে, বিশ্বের দুই হাজার ৫৮০টি ভাষা হারিয়ে যাওয়ার পথে। ঝুঁকির পাঁচটি মাত্রায় এসব ভাষার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর এই তথ্য বলছে- বিলুপ্ত ভাষার সংখ্যা ২৩০টি। আর বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে দুই হাজার ৫০০টি। তবে গ্রহণযোগ্য অনুমানে ৩ হাজার বিপন্ন ভাষার কথাও বলছে তারা। এছাড়া অচিরেই বিলুপ্তির পথে রয়েছে অন্তত ৫০০ ভাষা। কারণ, এসব ভাষায় কথা বলার মতো ১০০ জনের কম মানুষ বেঁচে আছেন।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে ভাষা কেনো বিলুপ্ত হয়? ভাষাতাত্ত্বিকরা বলছেন, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে অনেক জাতিগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষা ব্যবহার করতে চায় না। ফলে পুরোনো প্রজন্মের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মরে যায় ওই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। যেমন ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী নারী হাজেল স্যাম্পসনের মৃত্যুর সাথে মরে যায় ‘ক্লাল্লাম’ ভাষা। তিনি এই ভাষার কথা বলার শেষ ব্যক্তি ছিলেন। আন্তর্জাতিক ভাষা গবেষণা সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, অস্ট্রেলিয়ার কেয়ার ডিলডসহ প্রায় ২০৪টি ভাষায় দশ জনেরও কম লোকে কথা বলে। রাশিয়ার ভটিক, নরওয়ে ও সুইডেনের উসিসামি ও পিটিসামি বিশ জনের কম লোক কথা বলে। তিব্বতের ডুজিকেন ভাষায় কথা বলার মতো ত্রিশজনের কম লোক বেঁচে আছেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ভাষা গিলে খেয়েছে অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার ভাষা। দীর্ঘদিন কোন ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলে সেটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এছাড়া কোন ভাষাভাষীর বিকল্প ভাষা ব্যবহারে নির্ভরশীল হয়ে পড়া, আঞ্চলিক ভাষার অবমূল্যায়ন, সঠিক ব্যবহার না করা, বিকল্প ভাষার দৌরাত্ম্য, বিদেশী ভাষা প্রীতিসহ ভাষা হারিয়ে যাবার নানা কারণ উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিলুপ্ত ভাষার একটি প্রোটো ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা: ইংরেজি, রাশিয়ান, বাংলাসহ পৃথিবীর অনেক ভাষায় এই ভাষা অবদান রেখে বিলুপ্ত হয়েছে। এটি অনেক পুরনো ভাষা। এর কোন লিপি এখন আর অবশিষ্ট নেই।
আইবেরিয়ান ভাষা: স্পেন ও পর্তুগালের অংশ তৎকালীন আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় বসবাসকৃত মানুষের ভাষা ছিলো এটি। রোমান শাসকরা আইবেরিয়ান পেনিনসুলা জয়ের পর ক্রমশ ভাষাটি বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমান স্পেনে বিলুপ্ত এই ভাষার কিছু অক্ষরের দেখা পাওয়া যায়।
হাট্টিক ভাষা: তৎকালীন আনাতোলিয়া অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের ভাষা বলেই মনে করা হয়। ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের হাতে আনাতোলিয়া পরাজিত ও দখলের মাধ্যমে ক্রমশ এই ভাষাটি হারিয়ে যায়।
এট্রুুস্কান ভাষা: পুরো ইতালিকে কয়েকশ বছর ধরে শাসন করেছিল এট্রুস্কান জাতি। সেই সময়েই বর্তমান রোমের নামকরণ করেছিলো তারা। এট্রুস্কান ভাষার শেষ কথক ছিলেন সিজার ক্লডিয়াস। তিনি এই ভাষায় লিখেছিলেন হিস্টোরি অব দ্য এট্রুস্কান। তবে বর্তমানে সেই বইটিও আর নেই, নেই এট্রুস্কান ভাষাও। এ তালিকায় আরও রয়েছে ডেসিয়ান, এটিওক্রেটান, পুরনো তিব্বতী, ওল্ড চার্চ স্যালভোনিক, গিজসহ শত শত ভাষা। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় অনেক ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে চলছে তৎপরতা। যেমন প্রাচীন হিব্রু ভাষা ইসরাইল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রক্ষার চেষ্টা চলছে।
ইথনোলগ তাদের সর্বশেষ সংস্করণে উল্লেখ করেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক কথা বলে চীনা ভাষায়। তার পরই রয়েছে স্প্যানিশ, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি আর এই তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে বাংলা ভাষা। আর দেশভিত্তিক সর্বোচ্চ ভাষা রয়েছে পাপুয়া নিউগিনিতে। সেদেশে ৮৪১টি সচল কথ্যভাষা রয়েছে। এরপর ইন্দোনেশিয়া ৭১০টি ভাষা, নাইজেরিয়া ৫২৬টি, ভারত ৪৫৫টি, যুক্তরাষ্ট্র ৩৩৪টি, চীন ৩০২টি, মেক্সিকো ২৯২, ক্যামেরুন ২৭৮, অস্ট্রেলিয়া ২৫০টি আর ব্রাজিলে ২২৮টি কথ্যভাষা নিয়ে রয়েছে দশম স্থানে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাচিত্র
বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু এসব জাতিগোষ্ঠী ও তাদের ভাষা নিয়ে তথ্য সংকট রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে লেখালেখি হলেও সামগ্রিকভাবে নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা হয়নি। জাতীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গ ভাষাশুমারি হয়েছে এমন তথ্যও নেই। বিভিন্ন শুমারিগ্রন্থে ভাষাবিষয়ক যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলোও পর্যাপ্ত নয়। এজন্য বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত সেন্সাস রিপোর্ট ও গবেষণাপত্রের পরিসংখ্যানে ভিন্নতা দেখা যায়। ১৯৯১ সালের জনশুমারিতে এদের সংখ্যা ২৯ বলে উল্লেখ আছে। আর ২৭টি সম্প্রদায়কে নিয়ে ’ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ পাশ করা হয়। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের ‘পলিটক্যিাল ইকোনমি অফ আন পিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা গ্রন্থে তিনি বলেছেন- বাংলাদেশে সরকার ২২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে স্বীকার করে না। ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে স্বীকার করা হলেও বাস্তবে দেশের ৪৮ জেলায় ৪৯টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। আর তাদের মোট জনসংখ্যা ৫০ লাখ, যদিও সরকারি হিসাবে ২৫ লাখ। জাতিতত্ত্ববিদ ম্যালোনির মতে এই সংখ্যা ৩৬ আবার ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও বাসুদেব ধর এই সংখ্যা ৪৫ বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ইনডিজেনাস কমিউনিটিস গ্রন্থে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। তবে ২০১৫ সালে আদিবাসী সংসদীয় ককাস জাতীয় সংসদে ৬৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিল উত্থাপন করে।
নৃগোষ্ঠীগুলো হলো: অসম/অহমিয়া, ওঁরাও/উড়াং, কন্দ/খন্দ, কর্মকার, কড়া/করোয়া, কোচ/রাজবংশী, কোল, খাড়িয়া, খারওয়ার, খাসি, খিয়াং, খুমী, গড়াৎ, গন্ড, গারো/মান্দি, গোর্খা, চাঁইমাল/চাঁই, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চঙ্গ্যা, তুরী, ত্রিপুরা, তেলী, পল্ল/পলিয়া, পাংখোয়া, পাত্র/লালেং, পাহাড়িয়া/মালপাহাড়ি/সাওরিয়াপাহাড়ি, পাহান, পু-্র/পোদ, বম, বর্মণ, বাড়াইক, বাগদী, বানাই, বাদিয়া/বেদিয়া, বীন/বিন্দ, বোনাজ/বোনা, ভূঁইমালী, ভূঁইয়া, ভূমিজ, মনিপুরী, মারমা/মং, মালো, মারমি/মুরমি, মাহাতো/কুর্মী মাহাতো, মাহালী, মুন্ডা/মুন্ডারি/মুরারী, মুসহর, মুরং, রাই, রাওতিয়া/সিং, রাখাইন/মগ, রাজোয়াড়, রানা-কর্মকার, লুসাই, লোহার/লহরা, শবর, সাঁওতাল, হদি, হাজং, রবিদাস, রুহিদাস, কর্নিদাস, ছত্রী, নুনিয়া।
কিন্তু এর বাইরে আরো অনেক জনগোষ্ঠী রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা। এবং দেশের চা বাগানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, ইংরেজরা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে চা শ্রমিক হিসেবে প্রায় ১১৬ টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে আসে। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন চা বাগানে বসবাসকারী ৯৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে আদিবাসী সংসদীয় ককাসের তালিকার বাইরে থাকা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হলো: অলমিক, অহির, কলিতা, কল, কাহার, কালোয়ার, কাতুরিয়া, কানু, কৈরালা, কৈরী, কারুয়া, কেডুরি, গঞ্জু, গঁয়াঅসূর, গড়, ঘাটোয়াল/মাঝি, ঘাসি, চাষা, জেনা, ঝরা, টাটের, ঠাকুরিয়া, তাঁতি/তন্তুবায়, তেলেগু, ত্রিপাঠী, তংলা, তেওয়ালি, দোসাদ, দেশওয়ারা, ধরকার, নাহক, নাগ, পাশি, পাত্র/মুড়া, পাইক, পাইনকা, পান্ডা, বেনবংশী, বেতরা, বাউরি, বাজোয়ার, শুভকর, ভর, মোদক, মানিকি, মন্ড, মাহার, মহান্তি, রজক/শব্দকর, রেলি/মাদ্রাজি, রাজবল্লব, শীল/হাজাম, শতনামি, হাউ, হাজরা।
এতো গেলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা, এবার আসি ভাষার প্রশ্নে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, দেশে নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা আছে ৪১টি। আরও বলা হয়েছে, ৪১টি নৃ-গোষ্ঠীর বেশিরভাগই ভাষা পরিবর্তন করেছে। এখনই তা সংরক্ষণ করা না গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপক্ষে আরও ১৫টি ভাষা হারিয়ে যাবার শঙ্কাও প্রকাশ করে তারা। আর ভাষা গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে প্রচলিত ৫২টি ভাষার মধ্যে বর্তমানে সচল ৪২টি। শত বছরের ব্যবধানে বাকি দশটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ইথনোলগের সর্বশেষ তথ্যমতে বাংলাদেশে বাংলাভাষাসহ ৪১টি কথ্যভাষা রয়েছে। ভাষাগুলো হলো- আটং, বাংলা, বাংলা সাইন/ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাংগুয়েজ, বিহারী, বিষ্ণুপ্রিয়া, চাক, চাকমা, চিন আসো, চিন বাওয়েম, চিন খুমি, চাঁটগাইয়া, গারো/মান্দি/আচিক, হাজং, খাসি, কোচ, কোদা, কোকবরক, কোল, কুরুক, লিংগাম, মাহালি, মারমা, মেগাম, মেইথেই/মনিপুরি, মিজো, মুন্ডারি, পাংখোয়া, প্নার, রাখাইন, রংপুরী, রিয়াং, রোহিঙ্গা, সাদরী ওরাওন, সাঁওতালি, সাওরিয়াপাহাড়ি, সিলেটি, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরী, উশোই এবং ওয়ার জৈন্তিয়া।
কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থে এই তালিকার বাইরে আরো কিছু ভাষার নাম জানা যায় যেমন: ডবহারি, আসামী, ডবঞ্জপুরি, সৌরি, মালতো, চীন ফালাম, চীন হাকা, এরমা, মিটেই, মারো, দাবলং, শেন্দু, হো, ওড়িয়া, ছত্তিশগড়ি, মাদ্রাজি, ভুজপুরী, তেলেগু, নেপালি, হাজাজা, হালাম, সন্ধৌগ, টেপি, ঠার, বনজুগী, চল্ক, পালেয়ো, ডালুই, বুনো ও মাগধীসহ আরো কিছু নাম। কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে আলাদা ভাষা-জনগোষ্ঠী নাকি উল্লিখিত ভাষাভাষীর গোত্র অথবা প্রতিনাম সেটা নিশ্চিত না। কারণ ইথনোলগের তালিকায় ত্রিপুরী এবং ককবোরক আলাদা ভাষা দেখানো হয়েছে আসলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ভাষাই ককবোরক। আবার উশোই ভাষাভাষী ত্রিপুরীদেরই একটি গোত্র বলে মত প্রকাশ করেন গবেষকরা। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এ উল্লিখিত মং এবং মারমা আলাদা জাতিগোষ্ঠী দেখানো হয়েছে কিন্তু পরে মারমারাই মং বলে শনাক্ত করা হয়। আবার জনগোষ্ঠী হিসেবে মনিপুরীদের একবার গণণা করা হয়েছে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে মেইথেই ও বিষ্ণুপ্রিয়া আলাদা গণণা করা হয়েছে। আবার একই ভাষায় একাধিক জনগোষ্ঠীও কথা বলতে পারে। এসব বিষয়ে বিশদ গবেষণার দাবি রাখে।
গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা প্রধানত চীনা-তিব্বতি বা তিব্বতি-বর্মি ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তবে চাকমা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত। অস্ট্রো-এশিয়াটিক পরিবারভুক্ত ভাষাগুলোর মধ্যে উল্লেখখযোগ্য হলো: খাসি, সাঁওতালি ও মুন্ডা। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা-পরিবারের একমাত্র সদস্য ওরাঁও বা উড়াং। তাদের ভাষা কুরুুখ।
ভাষাবিজ্ঞানে মুখের ভাষাকেই জীবন্ত ভাষা বলা হয়েছে। কিন্তু ভাষা বলতে মৌখিক ও লিখিত উভয়কেই বোঝায়। ভাষার লিখিত ব্যবস্থা না থাকলে তা স্থায়ী হয় না। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা হুমকির এটিও কারণ। খুব কম নৃ-ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। আর নিজস্ব হরফ না থাকায় অধিকাংশ ভাষা রোমান অথবা অন্য ভাষার বর্ণমালা দিয়ে লিখতে হয়।
ইউনেস্কোর তথ্যমতে সবচেয়ে বেশি ভাষা হারানোর শঙ্কায় রয়েছে ভারত। ভারতের ১৯৬টি ভাষাকে বিপদগ্রস্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ থেকেই শতাধিক ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশেরও ৫টি ভাষাকে বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম হলে ওই ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। সেই হিসাবে বাংলাদেশের অনেক নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার দেশে নৃ-মাতৃভাষার অনাদর সহাবস্থান
মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠায় বাঙালির সংগ্রাম এখন বিশ্বজয়ী। বাংলাদেশে বাঙালিরা সব অর্থেই এখন গরিষ্ঠ অথচ মাতৃভাষা নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে। এর মধ্যে তাদের কিছু ভাষা হারিয়ে গেছে। বাকিগুলো রক্ষার জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় সমর্থন, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং মাতৃভাষার প্রতি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর অঙ্গীকারের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও উদ্যোগের সংকট রয়েছে অনেক।
বাংদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিরা ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরও অংশগ্রহণ ছিলো। রাষ্ট্র এখনও তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে না। তাদের ভাষার স্বীকৃতি দেয়নি। আর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে ১০৭ নাম্বার কনভেনশনের ২৩(১) অনুচ্ছেদে সকল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশও সই করেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে এই অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যদিও ইতোমধ্যে পাঁচটি ক্ষুদ্র ভাষার শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এতিহ্যের বিপন্ন অবস্থা থেকে রক্ষার তেমন উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার দেশে অন্য ভাষাভাষীদের ভাষা সংস্কৃতি সংকটে থাকার বিষয়টি লজ্জার। কেননা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মূল লক্ষ্যই হলো বিশ্বের সকল ভাষার নমুনা সংরক্ষণ করা প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং মৃতপ্রায় ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার কিন্তু পুঁজিবাদী আগ্রাসন, ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও নব্য ঔপনিবেশিক শোষণ ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভাষার অধিকারকে চরম অবহেলিত করেছে এবং ভাষাকে করেছে সংকটাপন্ন। এ কারণে ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে জাতিসত্ত্বাগুলোর দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। মাতৃভাষার মতো একটি মৌলিক সাংস্কৃতিক উপাদানের অস্থিত্বের সংকট রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া মোকাবিলা সম্ভব হয়না। সংকটাপন্ন জাতিগুলোর ভাষা স্বীকৃতির মাধ্যমেই সেই সংকট কাটানো সম্ভব। এতে আমাদের জাতীয় উন্নয়ণ, সামগ্রীক অগ্রগতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি আরো টেকসই হবে।
তথ্যনির্দেশ:
জুম পাহাড়ের অধিকার, ইলিরা দেওয়ান, ঢাকা, ২০১১। সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সুবোধ হাঁসদা, কলকাতা, ২০০৪। চাকমা ভাষা চর্চা কোন পথে, পুলক বরণ চাকমা, প্রথমআলো, ২৬ ডিসেম্বর,২০১৩। ইথনোলগ ও ইউনেস্কোর ওয়েব সাইট এবং জাতীয় তথ্য বাতায়ন। আদিবাসীদের মাতৃভাষার কী হবে? সঞ্জীব দ্রং, শিখা, মৌলভীবাজার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। আদিবাসী প্রেক্ষিত ও শব্দকর সমাজ সমীক্ষা, রসময় মোহান্ত, মৌলভীবাজার, ১৯৯৮। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা, প্রশান্ত ত্রিপুরা, প্রথমআলো, পাঁচ ফেব্রুয়ারিÑ ২০১৪। আদিবাসী সংসদীয় ককাস কর্তৃক জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিলÑ ২০১৫। বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা, কামাল চৌধুরী, প্রথম আলো ২১ ফেব্রুয়ারিÑ ২০১৩। কালপ্রবাহে আদিবাসী, সালেক খোকন, ঢাকাÑ ২০১৬। মাতৃভাষা নিয়ে লড়াই, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, প্রথম আলো, পহেলা ফেব্রুয়ারিÑ ২০১৮। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনÑ ২০১০।
লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী।
Leave a reply